
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সফলকাম ব্যক্তিরাই হবেন বিচার দিনে বিশেষ সম্মানের অধিকারী । মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাদের অভিহিত করেছেন সাবিকুন বা অগ্রগামী বলে । তিনি বলেন—
والسبقُونَ السَّبِقُونَ – أُولَيْكَ الْمُقَرَّبُونَ
‘আর অগ্রগামীরা তো অগ্রগামী-ই। তারাই নৈকট্যলাভকারী।’ ( সূরা ওয়াকিয়া : ১০-১১)
হাশরের মাঠে যখন মানুষ ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ বলে বিলাপ করতে থাকবে, নিজের আমলনামা দেখে কঠিন পরিণামের ভয়ে বুক চাপড়াবে, পিপাসায় কাতর হয়ে আর্তচিৎকার দেবে পানি পানি বলে, তখন এই সাবিকুন তথা অগ্রগামীরা থাকবেন পরম নিশ্চিন্তে আরশের ছায়াতলে। তাঁদের জন্য প্রস্তুত থাকবে নিয়ামতপূর্ণ জান্নাত, যেখানে তারা মণিমুক্তা খচিত আসনে হেলান দিয়ে বসবেন। সামনে উপবিষ্ট থাকবে ডাগর ডাগর চোখের অধিকারী অপূর্ব মোহনীয় রূপসি হুর! যেন তারা লুকিয়ে রাখা কোনো দুষ্প্রাপ্য মুক্তো। আতিথেয়তার জন্য তাঁদের চারপাশে প্রজাপতির মতো বিচরণ করবে সুশ্রী বালকের দল! সেই স্নিগ্ধ পরিবেশে আকর্ষণীয় পাত্রে তাঁরা পরিবেশন করবে সুমিষ্ট শরাব; যাতে না থাকবে মত্ততা, না আসবে কোনো ঘোর!
জান্নাতিদের জন্য আয়োজন করা হবে এক জাঁকালো মহোৎসব! সেই উদ্যাপনে অংশ নেওয়াই হবে মানব জীবনের পরম ও চরম সার্থকতা! অপরদিকে এই মহা আয়োজনে যারা আমন্ত্রিত হবে না, তাদের মতো দুর্ভাগা আর কে আছে! জীবনের সকল পাওয়া যে সেদিনেই পূর্ণ হবে। চক্ষু শীতল হবে, তৃপ্ত হবে ভূষিত হৃদয়। সেদিন সমস্ত পর্দা উঠে যাবে, উবে যাবে সমস্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আকাশ ও জমিনে বইবে শুধুই প্রশান্তির মোলায়েম বাতাস! সেদিন সময় থমকে যাবে, আটকে যাবে চোখের পলক। চারিদিকে বিরাজ করবে মহা মোলাকাতের আমেজ।
কারণ, সেদিন যে দেখা দেবেন আমাদের অস্তিত্বের কারিগর, আমাদের একান্ত আপনজন, সর্বোত্তম অভিভাবক, মমতার আধার, অনুগ্রহের উৎস, মহামহিম রব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা! বান্দাকে দর্শন দিতে তিনি নিজের পবিত্র চেহারার রওশনকে সেদিন উন্মুক্ত করবেন! যে স্রষ্টাকে কোনোদিন দেখিনি, শুধু অনুভব করেছি হৃদয়ের গহিন তলে! যাঁর অস্তিত্বের ব্যাপারে কখনো কোনো সন্দেহ ঠাঁই দিইনি মনে; বরং শত কুমন্ত্রণা সত্ত্বেও যাঁকে বিশ্বাস করেছি একনিষ্ঠ চিত্তে! যাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের অপেক্ষায় থেকেছি এতকাল! সৃষ্টিলগ্ন থেকে আজতক ভোগ করে চলেছি যাঁর অনুগ্রহ! যিনি কঠিন মুসিবতে যাবতীয় বিপর্যয় থেকে দিয়েছেন পরিত্রাণ, বিচারের কঠিন দিনে যে রব আমাদের মুক্তির একমাত্র সহায়, বিশ্বাসের প্রতিদানে রহমতের পালক মেলে যেই মহান সত্তা আমাদের স্থান দিয়েছেন অনাবিল সুখের ঠিকানা জান্নাতে, সেই অবিনশ্বর প্রভু তাশরিফ আনবেন তাঁর নগণ্য বান্দাদের সামনে!
এ যে মহাসৌভাগ্য! পরম পাওয়া! বান্দার প্রতি স্রষ্টা প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উপহার! রবের পবিত্র নুরের ঝলকে সেদিন বান্দার পলক থমকে যাবে। একাগ্র মনোযোগে স্রষ্টার পানে তাকিয়ে কেটে যাবে কত শত কাল! দৃষ্টি দিয়েছেন যে রব, পলক মেলে তাঁকেই দেখবে চোখ। এ যে সৃষ্টির চূড়ান্ত সার্থকতা! বর্ণনাতীত সাফল্য! সেদিন মহান আল্লাহ স্বয়ং তাঁর আদরের বান্দাদের আবৃত্তি করে শোনাবেন কুরআনের অমিয় বাণী। আর পরম প্রভুর অকল্পনীয় মধুর ধ্বনিতে সিক্ত হবে মানব হৃদয়!
পরজগতের সেই মহা আনন্দোৎসবে আমন্ত্রণ পাওয়ার জন্য প্রধান যোগ্যতা হবে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন! আর তার জন্য অপরিহার্য পাথেয় হলো-
১. আল্লাহর প্রতি নিখাদ ভালোবাসা
২. তাঁর নৈকট্য অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা
৩. তাঁর পথনির্দেশ অনুসরণ এবং
৪. ভালোবাসার প্রমাণস্বরূপ যেকোনো ত্যাগ স্বীকার ও পরীক্ষার জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি।
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য বান্দাকে কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। আর প্রতিটি ধাপেই ভেদ করতে হয় অবাধ্যতার পর্দা। এভাবে ধারাবাহিক চর্চার মধ্য দিয়ে বান্দা আস্তে আস্তে রবের নৈকট্যের দিকে এগিয়ে যায়। আর রবের সামনে হাজির হওয়ার জন্য নিজেকে করে তোলে অধিকতর প্রস্তুত ও পরিপাটি। সেই ধাপগুলো হলো—
নৈকট্যের সূচনা : স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক চিরন্তন। এই সম্পর্ক কখনোই ছিন্ন হওয়ার নয়। তিনিই আমাদের পরম আদরে সৃষ্টি করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, শত অবাধ্যতা সত্ত্বেও প্রতি মুহূর্তে ঢেলে দিচ্ছেন অনুগ্রহের বারিধারা। তিনি বলেন-
وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ –
‘আর আমার রহমত সকল কিছুর ওপর পরিব্যাপ্ত।’ (সূরা আ’রাফ : ১৫৬)
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক একপাক্ষিক, যেখানে মনিব শুধু দিয়েই যাচ্ছেন আর বান্দা অবিরাম ভোগে মত্ত। কিন্তু এটি কারও অজানা নয় যে, একপাক্ষিক আগ্রহে সম্পর্ক কখনোই জমে ওঠে না। এতে মনিবের সন্তুষ্টি কিংবা নৈকট্য অর্জন করা মোটেই সম্ভব নয়। শোকরহীন এমন একতরফা ভোগকে বলে অকৃতজ্ঞতা। আর অকৃতজ্ঞতার পেয়ালা হাতে মালিকের গভীর সম্পর্কের আবেহায়াত পান কী করে সম্ভব! সুতরাং ভালোবাসা হতে হবে উভয়পাক্ষিক। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন—
يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَه
‘আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, তারাও আল্লাহকে ভালোবাসে।’ (সূরা মায়েদা : ৫৪)
বান্দা যখন আল্লাহর রঙে রঙিন হতে চায়, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হয় এবং প্রস্তুত থাকে যাবতীয় ত্যাগ স্বীকারের জন্য, তখন পরম করুণাময় রব এই ভালোবাসার স্বীকৃতস্বরূপ নিজের নৈকট্যের দুয়ার খুলে দেন।
আল্লাহর নৈকট্যের সূচনা হয় তাঁর প্রতি ঈমান আনার মাধ্যমে। এই ঈমান বা বিশ্বাস তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথমে অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে হয় আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি যাবতীয় অংশীদারত্ব থেকে মুক্ত একক ও সয়ম্ভূ সত্তা। ভালো-মন্দের মালিকও একমাত্র তিনিই। তিনিই আমাদের প্রতিপালন করেন, রিজিক বণ্টন করেন, বিধান দেওয়ার কর্তৃত্বও তাঁর হাতে। সবশেষে আমরা সবাই তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তন করব। মুহাম্মাদ * তাঁর বান্দা ও মনোনীত রাসূল। এই বিশ্বাসসমূহের মৌখিক ঘোষণা এবং সর্বশেষ তা কর্মে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঈমানের শর্ত পূরণ হয়।
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে আমলে পরিণত করার জন্য রাসূল -এর দেখানো পথে হাঁটতে হবে। তাঁকে অনুসরণ করতে হবে প্রতিটি পদক্ষেপে। তিনি যেভাবে যা কিছু করেছেন, করতে বলেছেন, সেভাবেই তা সম্পন্ন করতে হবে। এটাই আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ
ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ –
‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার নবির অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেবেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৩১)
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এবং আনুগত্যের ঘোষণাদানের মধ্য দিয়েই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রথম শর্ত পূরণ হয়। এরপর শুরু হয় মূল যাত্রা । এই যাত্রায় আস্তে আস্তে নিজেকে ভাঙতে হয় এবং নতুন করে গড়তে হয় রবের দেওয়া ছাঁচে। বাধ্য হয়ে কিংবা লোকদেখানোর জন্য নয়, ভাঙা- গড়ার এই প্রক্রিয়া চলে সহজাত ভঙ্গিমায়। সৃষ্টি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অগ্রসর হচ্ছে তার স্রষ্টার দিকে—রবের জন্য এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে!
নৈকট্যের অগ্রযাত্রা : আল্লাহর নৈকট্যলাভের যাত্রা শুরু হয় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। কেননা, তিনি আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি করে। মানব সৃষ্টির সূচনাকালে তিনি ফেরেশতাদের বলেছিলেন—
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةٌ
‘স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই।’ (সূরা বাকারা : ৩০)
মালিকের নির্দেশের বাইরে প্রতিনিধির নিজস্ব বলতে কিছুই থাকে না। তার প্রতিটি পদক্ষেপ নির্ধারিত হয় মালিকের নির্দেশনার আলোকে। তাই প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের দায়িত্ব হলো—আল্লাহর হুকুম-আহকাম পুরোপুরি মেনে চলা এবং তাঁর আদেশ বাস্তবায়ন করা। আল্লাহ তায়ালার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হুকুম হলো—মানুষকে ভালো কাজের উপদেশ দেওয়া এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করা। সুতরাং, এই দায়িত্ব পালন করাও প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত।
দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতিনিধিকে প্রথমেই মালিকের আদেশ-নিষেধসমূহ পরিপূর্ণভাবে জেনে নেওয়া আবশ্যক। এরপরই লেগে পড়তে হয় তা বাস্তবায়নের একান্ত প্রচেষ্টায়। মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনামা হলো পবিত্র কুরআন। এই মহাগ্রন্থেই রয়েছে মানুষের সমস্ত প্রয়োজন ও সংকট মোকাবিলার কার্যকর রোডম্যাপ, সন্নিবেশিত হয়েছে সর্বোত্তম উপায়ে জীবন পরিচালনার চূড়ান্ত মূলনীতি। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
ذلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ : هُدًى لِلْمُتَّقِينَ –
‘এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। এটি মুত্তাকিদের জন্য পথপ্রদর্শক।’ (সূরা বাকারা : ০২)
شَهُرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَتٍ مِّنَ الْهُدى وَالْفُرْقَانِ
‘কুরআন নাজিল করা হয়েছে রমজান মাসে, যা মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন, যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)
সুতরাং, প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের কাজ হবে কুরআন-হাদিস ও ইসলামি শরিয়াহর বিধিবিধান সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞানার্জন এবং তা বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করা। এই সকল তৎপরতার মধ্য দিয়েই আরম্ভ হবে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের দিকে আমাদের আনুষ্ঠানিক যাত্ৰা ।
নৈকট্যের শর্ত পূরণ : আমরা ঈমান আনার মাধ্যমে রবের সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হই। সেই চুক্তির আওতায় নিজের জান ও মাল তাঁর নিকট সমর্পণ করি জান্নাতের বিনিময়ে। আল্লাহর সাথে এই কৃত চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন করা তাঁর নৈকট্যলাভের অন্যতম শর্ত। মহান আল্লাহর ঘোষণায়—
اِنَّ اللهَ اشْتَرى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ
الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيْلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ
‘প্রকৃত ব্যাপার হলো—আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং (যুদ্ধের ময়দানে) মারে ও মরে।’ (সূরা তাওবা : ১১১ )
আমরা যারা ঈমান এনেছি, তারা প্রত্যেকেই এই চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি। এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন এবং বিনিময়ে পরকালে প্রস্তুত রেখেছেন সুশোভিত জান্নাতের বাগিচা। তবে আল্লাহ আমাদের থেকে ক্রয়কৃত জীবন ও সম্পদ আমাদের কাছেই আমানত রেখেছেন। শর্ত কেবল একটাই; যেন তাঁর নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যেই জীবনকে ভোগ করি, সম্পদকে ব্যয় করি তাঁর দ্বীনের স্বার্থে। এই চুক্তি যথাযথভাবে মেনে চললেই কেবল রবের নৈকট্য অর্জন সম্ভব হবে।
নৈকট্যের সুধা লাভ : যখন বান্দার সকল কাজের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, প্রফুল্লচিত্তে, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে যখন সে ঘোষণা দেয়—
اِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَ
‘আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ— সবই সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য।’ (সূরা আনআম : ১৬২)
ঠিক তখনই সে পরম করুণাময় রবের নৈকট্যের সুধা লাভ করে। পান করে রবের রেজামন্দির আবেহায়াত। এই পর্যায়ে বান্দা ও রবের মাঝে কোনো অবাধ্যতার পর্দা থাকে না, থাকে না কোনো অভিমান-অনুযোগ। ফলে বান্দা হয়ে যায় রবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু; যেমন বন্ধু হয়েছিলেন প্রিয় পয়গম্বর সাইয়্যিদুনা ইবরাহিম (আ.)।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন মানুষের জন্য কঠিন কিছু নয়। কেননা, তিনি তো অন্তর্যামী! মানুষের মনের যাবতীয় খবর সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল । তিনি মানুষের কর্মসমূহ মূল্যায়ন করেন তাদের নিয়্যাত ও আন্তরিকতার ওপর ভিত্তি করে। বাহ্যিক আবরণ তাঁর কাছে গৌণ। রাসূল
বলেন-
‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক চেহারা ও সম্পদ দেখেন না; দেখেন তোমাদের অন্তর ও কর্মকাণ্ড।’ (মুসলিম : ২৫৬৪)
আল্লাহ দুর্বল বান্দার জন্য সহজ করতে চান; দূর করতে চান সব রকম জটিলতা। তিনি বান্দাকে ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অপছন্দ করেন শাস্তি বা আজাবে নিপতিত করতে। প্রার্থনা করলে তিনি খুশি হন; না চাইলে হন রুষ্ট । মনের খবর জানার ক্ষেত্রে তিনি বান্দার অতি সন্নিকটে ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ
‘আমি তার গলদেশের শিরা অপেক্ষাও অধিকতর নিকটবর্তী।’ (সূরা কাফ : ১৬)
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ
فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ –
‘(হে নবি!) আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন তাদের বলুন—আমি এত নিকটবর্তী যে, কেউ যখন আমাকে ডাকে, তখন তার ডাক শুনি । সুতরাং তারাও আমার কথা অন্তর দিয়ে গ্রহণ করুক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে আসে।’ (সূরা বাকারা : ১৮৬)
আমরা যদি আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হই, নিয়্যাতকে পরিশুদ্ধ করি, দুই হাত বাড়িয়ে দিই রবের নৈকট্যের দিকে, দ্বীনকে পরিণত করি সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে, তাহলে আমাদের প্রতি তিনি রহমতের বারিধারা বর্ষণ করবেন। তাঁর দিকে এক হাত অগ্রসর হলে তিনি দুই হাত এগিয়ে আসবেন আমাদের দিকে । হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন—
‘যে ব্যক্তি আমার দিকে এক বিঘত পরিমাণ এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। যে ব্যক্তি আমার দিকে এক হাত পরিমাণ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দুই হাত এগিয়ে যাই। আর যে ব্যক্তি আমার দিকে পায়ে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে যাই দৌড়ে দৌড়ে।’ (মুসলিম : ৬৭২৬)
এই হাদিস সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন-
‘মানুষ! তুমি যদি দুনিয়ার কোনো বাদশাহের দরজায় যাও, হয়তো সে তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে না। ফিরেও তাকাবে না তোমার দিকে; এমনকী তোমাকে তার কাছে ভিড়তেই দেবে না। কিন্তু সকল বাদশাহের বাদশাহ বলছেন—“যে ব্যক্তি আমার দিকে হেঁটে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে দৌড়ে যাই ।” তবুও তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য কিছুর পেছনে দৌড়াচ্ছ! তুমি সবচেয়ে জঘন্যভাবে প্রতারিত হচ্ছ এবং পথ হারিয়ে দিশাহীন হয়ে পড়ছ।’
মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন—
يَايُّهَا الإِنْسَانُ مَا غَرَكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ –
‘হে মানুষ! কোন জিনিস তোমাকে তোমার রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে?’ (সূরা ইনফিতার : ৬)
মানুষ যখন আল্লাহর নৈকট্যের সুধা পান করে, তখন আর কোনো হতাশা, দুঃখ, ক্লেশ বা অপ্রাপ্তির বেদনা তাকে স্পর্শ করতে পারে না, পথভ্রষ্ট করতে পারে না দুনিয়ার কোনো মোহ। নিজের সমস্ত প্রচেষ্টা, অর্জন সে তখন সঁপে দেয় মহান প্রভুর উদ্দেশে। নিজের ক্যারিয়ারকে পরিচালিত করে আল্লাহ নির্দেশিত পথে, সমস্ত সম্পদ-মেধা-শ্রম ব্যয় করে উম্মাহর স্বার্থে। ক্ষমতা- অর্থ-বৈভব যত বাড়তে থাকে, তত বেশি সে নিজেকে নিয়োজিত করে মানবতার কল্যাণে। স্রষ্টার আনুগত্য আর সৃষ্টির সেবাই হয় তাঁর প্রধান কাজ । তাঁর হাত ও মুখ দ্বারা নিশ্চিত হয় অন্য সকল মানুষের নিরাপত্তা ।
সমাজে যখন আল্লাহর নৈকট্যলাভকারী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন সমাজ হয়ে যায় শান্তির বসুধা। হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা ভুলে মানুষ তখন পরস্পরের কল্যাণ কামনায় রত হয়। ব্যক্তিস্বার্থ উপেক্ষা করে নিজেকে উৎসর্গ করে বৃহত্তর উম্মাহর তরে। আল্লাহর দেওয়া যোগ্যতা ও সক্ষমতা ব্যয় করে তাঁরই সৃষ্টির মঙ্গলার্থে। এভাবে মানুষ ক্রমশ তার অধিকার ফিরে পায়; দূরীভূত হয় অন্যায়-অত্যাচার আর দুর্নীতির দূষিত সংস্কৃতি। সমাজকে বর্ণিল করে তোলে শান্তি ও সমৃদ্ধির জান্নাতি আমেজ ।