
আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে নেওয়ার স্বীকারোক্তির পর বান্দার প্রথম কর্তব্য হলো—তাঁর নির্ধারিত ফরজ ইবাদতসমূহ যথাযথভাবে পালন করা। ফরজ ইবাদত উপেক্ষা করে কখনোই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সম্ভব তো নয়; বরং এর মাধ্যমে বান্দা ও রবের মাঝে সৃষ্টি হয় যোজন যোজন দূরত্ব। বান্দার অবাধ্যতার পর্দায় আড়াল হয়ে যায় রবের অপার অনুগ্রহ। ‘ফরজ’ বান্দার জন্য আল্লাহ নির্ধারিত অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। ফলে এই কর্তব্যকে এড়িয়ে চলার অর্থ আল্লাহর অপরিহার্য আদেশকেই উপেক্ষা করা, অবাধ্যতার আবর্জনায় নিজেকে কর্দমাক্ত করা। আর এটা তো সুবিদিত যে, অবাধ্যতার কালিমা গায়ে মেখে কখনো মনিবের নৈকট্য অর্জন করা যায় না।
অপরদিকে আবশ্যক ইবাদতগুলো যথাযথভাবে আদায়ের মাধ্যমে বান্দা অবচেতন মনেই এমন সব গুণাবলি অর্জন করে, যা তাকে ধাবিত করে রবের রেজামন্দির দিকে। কেননা, প্রতিটি ফরজ ইবাদতেরই রয়েছে আলাদা আলাদা গুরুত্ব ও হাকিকত। উদাহরণস্বরূপ, সালাত অশ্লীলতা ও পাপাচার থেকে আমাদের অন্তরকে পবিত্র রাখে, তৈরি করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের অবারিত সুযোগ। এর মধ্য দিয়ে রবের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ দুই-ই বৃদ্ধি পায়। নামাজের প্রতিটি রাকাতে আমরা উচ্চারণ করি রবের একত্ববাদ, মহত্ত্ব ও পবিত্রতার বাণী। আনুগত্যের শির নত করে দিই তাঁর কদম তলে । বারবার ঘোষণা করি—’আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি, তোমার কাছেই সাহায্য চাই।’ আমরা যখন একাগ্রচিত্তে এই দুআ করতে থাকি, মহান আল্লাহ তখন আর সাড়া না দিয়ে পারেন না। তবে কখনো তিনি বান্দার প্রার্থনার ফল তাৎক্ষণিক দান করেন, আবার কখনো তা জমিয়ে রাখেন আখিরাতের জন্য ।
অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলোর অন্যতম ‘সাওম’ আমাদের মাঝে সৃষ্টি করে তাকওয়া ও আত্মসংযম। এটি আমাদের চোখ, কান ও জিহ্বাকে নিয়ন্ত্ৰণ করতে শেখায়। ঢালস্বরূপ ভূমিকা রাখে সকল পাপের বিরুদ্ধে। আমাদের উদ্বুদ্ধ করে গলায় লাগাম পরিয়ে নফসকে কঠোর শাসন করতে, মানুষের প্রতি উদার ও মহানুভব হতে। এভাবে রবের হুকুমের ছাঁচে ফেলে সাওম আমাদের প্রস্তুত করে; নিয়ে যায় রবের একান্ত সান্নিধ্যে ।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত হলো জাকাত। লোভের বিষাক্ত রস নিংড়ে এটি আমাদের অন্তরকে বিশুদ্ধ করে। আল্লাহ দয়া করে আমাদের যে সম্পদ দিয়েছেন, সেখানে অন্য বান্দাদের জন্যও রয়েছে নির্দিষ্ট হক বা অধিকার। এই অংশটুকু আমাদের নয়; পুরোপুরি অন্যের। অপরকে অধিকার বঞ্চিত করে তা ভোগ করা আমাদের জন্য সম্পূর্ণ হারাম। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে অপর বান্দাকে এই প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়ার ফলে রবের সাথে গড়ে ওঠে মুমিনের ঘনিষ্ঠ মিতালি। নিশ্চিত হয় আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের পবিত্রতা । একই সঙ্গে মালিক খুশি হয়ে যান তাঁর বান্দার প্রতি। ফলে মালিকের নৈকট্য অর্জন নিছক সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় ।
একইভাবে হজ হলো চেতনাগতভাবে রবের দিকে ফেরার এক আনুষ্ঠানিক ভ্রমণ। দুনিয়ার দায় মিটিয়ে, সমস্ত ব্যস্ততা থেকে মুখ ফিরিয়ে বিশ্বজাহানের প্রতিপালক মহান রবের দিকে যাত্রা! বান্দার গায়ে তখন কবরের বসন, মুখে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনির তাওহিদি সাক্ষ্য। এ যেন মরণের আগেই মৃত্যুর মহড়া!
হজ আমাদের অন্তরে দুনিয়ার মোহ হ্রাস করে একত্ববাদের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে। অন্তরে জন্ম নেওয়া বর্ণবাদকে মুছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে গেঁথে ফেলে একটি সুতোয়। সমূলে ধ্বংস করে হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা জাতিগত ভেদাভেদ। এ বাৎসরিক মহাসম্মেলনে অংশ নিয়ে সারা বিশ্বের মুসলিম জনতা একযোগে ঘোষণা করে প্রতিপালকের বড়োত্ব ও মর্যাদা সবার পরিচয় তখন এক ও অভিন্ন; সকলেই সেখানে এক আল্লাহর নগণ্য বান্দা! কেবল এই চিত্রই মানুষের মন থেকে যাবতীয় হিংসা-বিদ্বেষ দূরীভূত করার জন্য যথেষ্ট । এজন্য ফরজ ইবাদতসমূহ অত্যন্ত গুরুত্ব ও যত্নের সাথে আমাদের যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। কেননা, এর মাধ্যমেই ত্বরান্বিত হবে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ।
নফল ইবাদত আদায় : মৌলিক ইবাদতসমূহ আদায় করতে আমরা বাধ্য কিন্তু ভালোবাসার দাবিই হলো বাধ্যবাধকতার ঊর্ধ্বে উঠে অতিরিক্ত কিছু করা। এতে সম্পর্ক গভীর হয়, বাড়ে পারস্পরিক বোঝাপড়ার রসায়ন।