Shopping Cart
৳ 0.00

No products in the cart.

আহ্বান: ড. মিজানুর রহমান আজহারি

নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ

কিয়ামুল লাইল : নফল ইবাদতসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো— কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদের সালাত। এই সালাত আল্লাহর সাথে বান্দার ভালোবাসাকে অধিক হারে বৃদ্ধি করে, সুদৃঢ় করে সৃষ্টি ও স্রষ্টার অকৃত্রিম সম্পর্ক। কেননা, এই সালাত আদায় করতে হলে বান্দাকে নফসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়ী হতে হয়, ত্যাগ করতে হয় আরামদায়ক ও প্রশান্তিময় ঘুম । বান্দা যখন আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে তার প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে যায়, তখন প্রভুর চেয়ে খুশি আর কেউ হন না।

তাহাজ্জুদ বান্দাকে আল্লাহর রেজামন্দির জন্য প্রস্তুত করে। নবুয়তের গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত করতে বিশ্বনবি এ-কে রাতের বেশিরভাগ অংশে তাহাজ্জুদের সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন আল্লাহ তায়ালা । তিনি বলেন—

يَأَيُّهَا الْمُزَّقِلُ – قُمِ الَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا – نِصْفَةً أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيْلًا –

اَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا – إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيْلًا –

‘হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী! রাতের বেলা নামাজে রত থাকো কিছু সময় ছাড়া। অর্ধেক রাত কিংবা তার চেয়ে কিছু কম করো অথবা তার ওপর কিছু বাড়িয়ে নাও। আর কুরআন থেমে থেমে পাঠ করো। আমি অতি শীঘ্রই তোমার ওপর একটি গুরুভার বাণী নাজিল করব।’ (সূরা মুজ্জাম্মিল : ০১-০৫)

এরপর রাসূল যখন নবুয়তের দায়িত্ব পালনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন, তখন আল্লাহ তাহাজ্জুদকে নফলে পরিণত করলেন। আর প্রিয় পয়গম্বরের জন্য ঘোষণা করলেন সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্থান। তিনি বলেন—

وَمِنَ الَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةٌ لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا

‘আর রাতে তাহাজ্জুদ পড়ো। এটি তোমার জন্য নফল । অচিরেই তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭৯) 

তাহাজ্জুদ আদায় শুধু নবিদের বৈশিষ্ট্য-ই নয়; এটি মুমিনদেরও একটি বিশেষ গুণ । আল্লাহ তায়ালা সফল মুমিনদের দিনলিপি বর্ণনা করে বলেন-

كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ الَّيْلِ مَا يَهْجَعُوْنَ وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ

‘রাতের বেলা তাঁরা কমই ঘুমাত। তাঁরা ক্ষমাপ্রার্থনা করত রাতের শেষ প্রহরে।’ (সূরা জারিয়াত : ১৭-১৮)

বিশ্বনবি বলেন-

‘মহান আল্লাহ প্রতিরাতের শেষ প্রহরে প্রথম আসমানে নেমে আসেন । আর বান্দাকে ডেকে ডেকে বলতে থাকেন—“কে আছ এমন, আমার কাছে চাইবে; আমি তোমার চাওয়া পূরণ করব। কে আছ এমন, আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে; আমি তোমায় ক্ষমা করে দেবো।”” (বুখারি : ১১৪৫)

মহান মনিব যখন সপ্তম আকাশ ছেড়ে নেমে আসেন ধরণির সন্নিকটে, পৃথিবীর দুয়ারে কড়া নেড়ে বান্দাকে আহ্বান করেন আদরের স্বরে, রবের প্রেমে মশগুল বান্দা তখন কীভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে? প্রভুর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কী করে আচ্ছন্ন থাকতে পারে গভীর নিদ্রায়? আরামের বিছানা যে তার কাছে মনে হয় বিরহের আগুন। ফলে রাতের নীরবতা ভেঙে উঠে পড়ে সে। মনের আগুনকে শান্ত করে অজুর সিক্ত পানি দিয়ে। অতঃপর দাঁড়িয়ে যায় প্রভুর সাথে শেষ রাতের মোলাকাতে ।

প্রবৃত্তি তো চায় শেষ রাতে বিছানায় আরাম করতে। বান্দা যখন সেই কামনাকে তুচ্ছ করে হাজির হয় রবের সামনে, তখন রব তার জন্য নৈকট্যের দুয়ার খুলে দিতে কার্পণ্য করেন না। তার জন্য প্রস্তুত করেন চির শান্তির নীড় জান্নাত । রাসূল বলেন—

‘রাতে উঠে নামাজে দাঁড়িয়ে যাও, যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। তাহলে তোমরা নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’

(মুসনাদে আহমদ : ৪৫১ )

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল

বলেন-

‘সেই ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তায়ালা রহম করুন, যে রাতের বেলায়

জেগে উঠে সালাত পড়ে এবং প্রিয়তমা স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়।

সে জেগে উঠতে গড়িমসি করলে মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়, যাতে সজাগ হয়। অনুরূপভাবে আল্লাহ সেই মহিলার প্রতিও রহম করুন, যে প্রথমে জেগে উঠে সালাত আদায় করে আর জাগিয়ে তোলে প্রিয়তম স্বামীকে। স্বামী জেগে উঠতে গড়িমসি করলে মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়, যাতে সে জেগে ওঠে।’ (আবু দাউদ : ১৩০৮)

কুরআন তিলাওয়াত : কুরআন তিলাওয়াত হলো আল্লাহর সাথে বান্দার কথোপকথন, তাঁর সঙ্গে নৈকট্য বৃদ্ধির অন্যতম কার্যকর উপায়। এ সুমহান বাণী তিনি পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন মানবজাতির হিদায়াতের উদ্দেশ্যে। এ কুরআন বান্দা ও রবের মধ্যকার সম্পর্কের সেতুবন্ধন। ফলে অর্থ অনুধাবন করে কুরআন তিলাওয়াত করলে মনে হবে—স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই আপনার সাথে কথা বলছেন। আবার কখনো মনে হবে—এতে আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে আপনার মনের সকল চাহিদা, আকুতি ও প্রার্থনা। আপনি তিলাওয়াত করছেন আর মনের অজান্তে প্রভুকে শুনিয়ে যাচ্ছেন নিজের প্রয়োজনের সকল ফিরিস্তি। কখনো মনে হবে—ঐতিহাসিক সব ঘটনা পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছেন। কখনো-বা মনে হবে—হাবুডুবু খাচ্ছেন তথ্য- উপাত্তের অথই সাগরে ।

জীবনবোধ, মোটিভেশন, উপদেশমালা, আইনি বিধিবিধান, প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা; কী নেই এতে! এ যেন মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়; যা আবৃত্তি করলে হৃদয় প্রশান্ত হয়, জেগে ওঠে ঘুমন্ত বিবেক। আবেগের দুয়ারে লাগে এক জ্যোতির্ময় ছোঁয়া। তাইতো রাসূল * কুরআন তিলাওয়াতকে আখ্যা দিয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত হিসেবে। রাসূল ইরশাদ করেন—

‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শেখে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।’ (আবু দাউদ : ১৪৫২)

অন্যত্র এসেছে-

‘তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো। কেননা, কিয়ামতের দিন

কুরআন তাঁর পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে।’ (মুসলিম : ৮০৪ )

অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে—

‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে, তার নেকি হবে দশগুণ হিসাবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মিম মিলে একটি হরফ; বরং আলিফ একটি, লাম একটি এবং মিম আরেকটি হরফ।’ (তিরমিজি : ২৯১০)

নফল রোজা : আল্লাহর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে নফল রোজা খুবই ফলপ্রসূ একটি উপায় । রোজার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হলো—এটি নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে দারুণ কার্যকর এক অস্ত্র। এ ধরনের অতিরিক্ত ইবাদত নফসের খায়েশকে দলিত করে হৃদয়ে জাগ্রত করে সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণ। একই সঙ্গে রোজা বান্দাকে নৈতিক পরিশোধনের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালার অধিক নিকটবর্তী করে তোলে। এজন্য রাসূল তাঁর জীবদ্দশায় সপ্তাহের প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার এবং মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে সিয়াম পালন করতেন। আমরাও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নবিজির অনুসরণে এই দিনগুলোতে নফল রোজা রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি।

দান-সাদাকা : আল্লাহ আমাদের যে রিজিক দিয়েছেন, সেখান থেকে অন্য ভাইয়ের জন্য খরচ করা বদান্যতার পরিচায়ক। এ ধরনের দান-সাদাকার মাধ্যমে অপরের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়, সুদৃঢ় হয় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। আল্লাহর সম্পদ দিয়ে তাঁরই সৃষ্টির সেবা করার সুযোগ তৈরি হয় এর মাধ্যমে। আর যে ব্যক্তি সৃষ্টির সেবায় সচেষ্ট হয়, মহান স্রষ্টা তার প্রতি সন্তুষ্ট হন সব থেকে বেশি। আমরা যা ভোগ করি, তা কোনো একসময় নিঃশেষে ক্ষয় হয়ে যায়। কিন্তু যা দান করি, তা মূলত আমাদের আমলনামাতেই গচ্ছিত থাকে, আমাদের জন্য বয়ে আনে চিরকালীন কল্যাণ ।

রাসূল

একবার একটা ভেড়া কুরবানি করে গোশত বিতরণ করলেন।

বিতরণ শেষে তিনি উম্মুল মুমিনিনকে জিজ্ঞেস করলেন-

‘ঘরে কিছু বাকি আছে কি?’ আম্মাজান জবাব দিলেন—‘ঘাড়ের গোশত ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।’ রাসূল

বললেন—

‘বরং সবকিছুই আছে (আমলনামায়), শুধু ঘাড়ের অংশটুকু ব্যতীত।’ (তিরমিজি)

দান অনেকটা লাইফটাইম ব্যাবসার মতো। দুনিয়ায় সামান্য বিনিয়োগ‍ই পরকালে ফিরে আসবে শতগুণ মুনাফাসমেত। এজন্যই আলি (রা.) বলেছেন—

‘আল্লাহর সাথে ব্যাবসা করো, অবশ্যই তুমি লাভবান হবে।’

একই কথা ধ্বনিত হয়েছে পবিত্র কুরআনে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيْلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللهُ يُضْعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ –

‘যারা আল্লাহর পথে নিজের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মতো, যা উৎপন্ন করে সাতটি শিষ। প্রতিটি শীর্ষে রয়েছে শত শস্যদানা। আর আল্লাহ যাকে চান, তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা বাকারা : ২৬১)

এজন্য মৃত্যু উপস্থিত হওয়ার আগেই সাধ্যমতো দান অব্যাহত রাখা উচিত । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

ياَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِي يَوْمٌ لَّا بَيْعٌ فِيْهِ وَلَا خُلَةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ

‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের যা কিছু ধন-সম্পদ দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করো সেই দিনটি আসার আগে, যেদিন কোনো কেনাবেচা চলবে না, বন্ধুত্ব কাজে লাগবে না এবং কারও কোনো সুপারিশও কাজে আসবে না।’ (সূরা বাকারা : ২৫৪ )

সাদাকার অর্থ-সম্পদ দেওয়া উচিত গরিব-দুঃখী, ফকির-মিসকিন, কন্যাদায়গ্রস্ত, ঋণ ও বিপদগ্রস্ত, ইয়াতিম অথবা অসচ্ছল শিক্ষর্থীকে। পাশাপাশি ইসলাম ও মানবসেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এবং নানাবিধ জনকল্যাণমূলক কাজেও ব্যয় করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিজ আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যারা অভাবী, তারা অন্য সাহায্যপ্রার্থীদের তুলনায় অগ্রাধিকার পাবে।

জিকির ও দুআ : আমাদের সমস্ত অবাধ্যতা আল্লাহকে ভুলে থাকারই অনিবার্য প্রতিফল । অন্তর যখন আল্লাহর কথা ভুলে যায়, তখন সেটা পরিণত হয় শয়তানের অভয়ারণ্যে। অপরদিকে যে অন্তরে আল্লাহর স্মরণ সদা বহমান, সে অন্তর থাকে সতেজ ও নির্মল । সেখানে থাকে না কোনো হতাশার অমানিশা, থাকে না অপ্রাপ্তির বেদনা। পাঁজরজুড়ে শুধু প্রবাহিত হয় শান্তির কলতান। জিকিরই অন্তরে বয়ে আনে এই অনাবিল সাকিনাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন— 

الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللهِ أَلَا بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنُ

‘এরা সেই সব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর জিকিরে প্রশান্তি লাভ করে। স্মরণ রেখ, কেবল আল্লাহর জিকিরই সেই জিনিস—যা দ্বারা অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয়।’ (সূরা রা’দ : ২৮)

মুমিনের ক্বলব মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর জিকির থেকে বিমুখ হয় না। তাদের অন্তরে সদা জাগ্রত থাকে আল্লাহু আকবার ধ্বনি। হৃদয়ে নিয়ত জারি থাকে রবের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে তারা সর্বাবস্থায় সর্বোচ্চ তৎপর। যে অন্তর মনিবের স্মরণে এতটা ব্যতিব্যস্ত, দয়াময় রব কী করে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেন! এমন একনিষ্ঠ গোলামকে ভালো না বেসে কীভাবে থাকবেন তিনি!

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন-

فاذْكُرُونى اَذْكُرُكُمْ –

‘আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব।’

(সূরা বাকারা : ১৫২)

এজন্য রাসূল

আমাদের জিহ্বাকে সর্বক্ষণ আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন । জিকিরের তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন—

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে, আর যে ব্যক্তি করে না,

তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃতের মতো।’ (বুখারি : ৬০৪৪ )

জিকির যেমনই জিহ্বার উচ্চারণের মাধ্যমে হতে পারে, তেমনই অন্তরের স্মরণ বা উপলব্ধির মাধ্যমেও হতে পারে। এর দ্বারা শুধু অবচেতন মনে আল্লাহর প্রশংসামূলক কিছু শব্দ উচ্চারণকেই বোঝায় না; বরং শয়নে-স্বপনে, কথাবার্তায়, চালচলনে, আচার-আচরণে তথা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহর দেওয়া নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করাও জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। তবে বিশেষ বিশেষ সময়ে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ বা বাক্য দ্বারা জিকির রাসূল -এর সুন্নাহ। এ শব্দমালা কিংবা দুআর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর স্মরণকেই জারি রাখা হয়। আমাদের প্রত্যেকের উচিত এই সমস্ত দুআ আত্মস্থ করে আল্লাহর দরবারে পেশ করা। বাজারে বিভিন্ন মাসনুন দুআ ও জিকির শেখার জন্য ছোটো ছোটো পুস্তিকা পাওয়া যায়। আমরা চেষ্টা করব সেখান থেকে অর্থসহ মাসনুন দুআ ও জিকিরগুলো মুখস্থ করে নিয়মিত আমলে করতে।

তওবা ও ইস্তেগফার : পাপ ও অবাধ্যতার পথ থেকে ফিরে এসে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা আল্লাহর নৈকট্যলাভের অন্যতম উপায়। বান্দা পাপ থেকে ফিরে এলে আল্লাহ ঠিক ততটাই খুশি হন, যতটা খুশি হন কোনো পথিক তার হারানো বাহন পুনরায় ফিরে পেলে। নবিজির খাদেম আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল বলেছেন—

‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দার তওবায় তোমাদের সেই ব্যক্তির চেয়ে বেশি খুশি হন, যে তার বাহনে চড়ে কোনো মরুভূমি বা জনহীন প্রান্তর অতিক্রম করছিল। অতঃপর কোনোক্রমে বাহনটি তার কাছ থেকে পালিয়ে যায় । বাহনের পিঠে ছিল সমস্ত খাদ্য ও পানীয়। এরপর তার ফিরে আসার ব্যাপারে লোকটি নিরাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে বাহনটি হঠাৎ তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আর সে তার লাগাম ধরে প্রভূত আনন্দে বলে ওঠে—“হে আল্লাহ! তুমি আমার দাস, আর আমি তোমার প্রভু!” সীমাহীন উচ্ছ্বাসে সে এমন ভুল করে ফেলে।’ (মুসলিম : ২৭৪৭)

আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ

বলেছেন—

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রাতের বেলা তাদের জন্য ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন, যারা দিনের বেলা গুনাহ করে। আর দিনের বেলা তিনি ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন তাদের জন্য, যারা রাতের অন্ধকারে পাপাচারে লিপ্ত হয়। সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়া পর্যন্ত এটি চলমান থাকে।’ (মুসলিম : ৭১৬৫)

গুনাহ করার পর শয়তান আমাদের কুমন্ত্রণা দিতে থাকে—’তুমি তো অনেক গুনাহ করে ফেলেছ। আল্লাহ তোমায় আর কখনোই ক্ষমা করবেন না । তিনি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত।’ এসব কুমন্ত্রণা দিয়ে শয়তান আমাদের

আল্লাহ থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে দেয়। দুর্বল করে দেয় আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের বন্ধন, কিন্তু মুমিন বান্দা ঘুণাক্ষরেও কখনো শয়তানের এমন কূটচালে প্রভাবিত হয় না; বরং ভুল করার সাথে সাথেই ইস্তেগফার ও তওবার আবেদন নিয়ে হাজির হয় প্রভুর দুয়ারে। আনাস (রা.)-এর বর্ণনায় রাসূল বলেছেন-

‘প্রত্যেক আদম সন্তানই গুনাহে লিপ্ত হয়; কিন্তু তাদের মধ্যে

ওই সকল লোকেরাই সর্বোত্তম, যারা অনুতপ্ত হয় এবং তওবা করে।’ (তিরমিজি : ২৪৯৯)

আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ

বলেছেন—

‘কসম সেই সত্তার, যাঁর হাতে গচ্ছিত আমার প্রাণ! যদি তোমরা গুনাহ না করতে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের এমন এক জাতিতে পরিণত করতেন, যারা গুনাহের পর আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করত, অতঃপর আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিতেন।’ (মুসলিম : ৭১৪১ )

জান্নাতে ইবলিসের প্ররোচনায় আমাদের আদি পিতা আদম (আ.) এবং আদি মাতা হাওয়া (আ.) উভয়েই ভুল করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁরা নিজেদের ভুলের স্বীকৃতি দিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন প্রতিপালকের কাছে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে সেই প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন—

قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ

“তারা বলল—“হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের ওপর দয়া না করেন, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।”” (সূরা আরাফ : ২৩)

প্রিয়নবি মুহাম্মাদ নিজেও দিনে অসংখ্যবার ইস্তেগফার করতেন; যদিও তিনি ছিলেন যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্ত, নিষ্পাপ ও নির্মল মহামানব। আম্মার ইবনে ইয়াসার মুজানি (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল বলেছেন-

‘হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর সমীপে তওবা করো এবং তাঁর নিকট ক্ষমা চাও। কেননা, আমি প্রতিদিন ১০০ বার তওবা করে থাকি।’ (মুসলিম : 2902 ) 

এজন্য আমরা নির্দিষ্ট কিছু সময় বাছাই করে নিজের পর্যালোচনা ও সমালোচনা করব। নিজের বিগত ভুলের জন্য ইস্তেগফার ও তওবা করব। এভাবে প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা ও ইস্তেগফারের মধ্য দিয়ে আমরা ধাবিত হব আল্লাহর নৈকট্যের দিকে। তবে মনে রাখতে হবে, শুধু আস্তাগফিরুল্লাহ… আস্তাগফিরুল্লাহ…বলাটাই তওবা নয়; এর জন্য রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট আদব ও পদ্ধতি ।

ইমাম মুহিউদ্দিন আন-নববি (রহ.) এ সম্পর্কে বলেন—

‘প্রত্যেক পাপ থেকে তওবা তথা চিরতরে প্রত্যাবর্তন করা সকলের জন্য ওয়াজিব। গুনাহ যদি হাক্কুল্লাহ তথা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে এবং হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকারসংক্রান্ত না হয়, তাহলে এ ধরনের তওবা কবুলের জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে—

১. সম্পূর্ণরূপে পাপাচার বর্জন ।

২. বিগত গুনাহের জন্য লজ্জা, অনুতাপ, অনুশোচনা ও ৩. পাপের পুনরাবৃত্তি না ঘটানোর ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প ।

এর একটি শর্তও যদি লুপ্ত হয়, তাহলে সেই তওবা বিশুদ্ধ হবে না। পক্ষান্তরে যদি সেই পাপ মানুষের অধিকার সম্পর্কিত হয়, তাহলে তার জন্য তওবা কবুল হওয়ার শর্ত চারটি। উপরিউক্ত তিনটির সাথে অতিরিক্ত চতুর্থ শর্ত হলো—‘হকদারকে তার প্রাপ্য পরিশোধ করা’। যদি কেউ অবৈধ পন্থায় কারও মাল হরণ করে থাকে, তাহলে অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে তা হকদারকে ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্যদিকে কারও প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিলে বা কোনোরূপ অন্যায় করে থাকলে সংশিষ্ট ব্যক্তির কাছে যথার্থ শাস্তির জন্য নিজেকে পেশ করতে হবে অথবা চাইতে হবে নিঃশর্ত ক্ষমা ।

নেককারদের সহবত : আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো সৎকর্মশীল সহকর্মী বা বন্ধু । রাসূল বলেছেন—

‘মানুষ তার বন্ধুর ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। সুতরাং সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে, তা যেন অবশ্যই যাচাই করে নেয়।’

(মুসনাদে আহমদ : ৮০১৫)

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন—

‘তুমি দৃঢ়চিত্ত হয়ে তাদের সাথে অবস্থান করো, যারা সকাল- সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবং দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে। তোমার দুই চোখ যেন তাদের থেকে ঘুরে না যায়। আর ওই ব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার অন্তরকে আমি আমার জিকির থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং যার কর্ম হয়েছে বিনষ্ট ।’ (সূরা কাহাফ : ২৮)

কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য জায়গায় উত্তম সহকর্মী বা বন্ধু নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভালো ও মন্দ বন্ধু জীবনকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে, রাসূল -এর উপমায় তা স্পষ্টতই উপলব্ধি করা যায়। তিনি বলেন-

‘ভালো ও দুষ্ট বন্ধু মেশক (সুগন্ধি) বহনকারী এবং হাঁপরে ফুঁৎকারদাতার (কামার) মতো। মেশক বহনকারী ব্যক্তির অবস্থা তো এমন; হয় সে এ মেশক তোমাকে উপহার দেবে, নয়তো তুমি তার থেকে সেটি খরিদ করবে অথবা তার থেকে লাভ করবে সুঘ্রাণ। আর হাঁপরে ফুঁকদাতা ব্যক্তি হয় তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে, নয়তো তুমি তার কাছ থেকে পাবে কেবলই দুর্গন্ধ।’ (বুখারি : ২১০১)

অপর একটি হাদিসে রাসূল

বলেন—

‘অসৎসঙ্গীর চেয়ে একাকিত্ব ভালো। আর একাকিত্বের চেয়ে সৎসঙ্গী ভালো।’ (শুয়াবুল ঈমান : ৪৬৩৯)

বলা হয়ে থাকে—‘সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ।’ এ কারণেই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্যে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে যুবকদের ক্ষেত্রে। কেননা, এ বয়সেই বিচিত্র বিষয়ের ওপর তীব্র কৌতূহল জন্মে এবং পাপকর্মে লিপ্ত হওয়ার যাবতীয় সুযোগ, শক্তি ও সক্ষমতা থাকে সবচেয়ে বেশি। ফলে এই বয়সে বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনাও ব্যাপক। তা ছাড়া এই বিশেষ কালপর্বের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভিত্তিতেই পরবর্তী জীবন পরিচালিত হয়। তাই এমন মানুষদের সাথে চলাফেরার চেষ্টা করতে হবে; যারা দাওয়া, তাজকিয়া ও অধ্যবসায়ে দিনাতিপাত করে । এতে পাপ থেকে বেঁচে থাকা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে, তৈরি হবে দ্বীন পালনের অদম্য উৎসাহ ।

নিয়মিত আত্মপর্যালোচনা : আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথে কতটুকু অগ্রসর হলাম, কোথাও বিচ্যুতি ঘটল কি না ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত পর্যালোচনা করা জরুরি। এতে নিজের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা সহজ হয়। একই সঙ্গে তৈরি হয় অধিকতর আত্মোন্নয়ন ও আত্মশুদ্ধির অবারিত সুযোগ । ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন—

‘প্রত্যেক মানুষের উচিত রাতে ঘুমানোর আগে একটি ঘণ্টা আল্লাহর জন্য ব্যয় করা। সেই সময়ে নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার— আজকের দিনে সে কী হারিয়েছে আর কী অর্জন করেছে। এরপর সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে এবং এ অবস্থাতেই নিদ্রা যাবে। প্রতিরাতেই এমনটি করা উচিত।’

আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য মুমিন জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক কে না চায়? কে না চায় তাঁর প্রিয়ভাজন হতে? কারণ, আল্লাহ যার হয়ে যায়, গোটা জগৎটাই তার হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কেউ হতে পারলে, প্রিয় সেলিব্রেটির একটা ফোন কল পেলে কিংবা প্ৰিয় মানুষটি হঠাৎ কাছে ডেকে নিলে আমাদের অনুভূতি কেমন হয়—ভেবে দেখুন তো! আর বিশ্বজাহানের অধিপতি স্বয়ং আল্লাহ যদি বলেন—‘আমি আমার এ বান্দাকে ভালোবাসি। হে ফেরেশতারা! তোমরাও তাকে ভালোবাসো।’ এমন পরিস্থিতে সে ব্যক্তির জীবনে অপ্রাপ্তি বলতে আর কিছু থাকে না। মানবজীবনের এটাই তো চূড়ান্ত সফলতা ।

সুতরাং নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনার কাছে সঁপে দেওয়ার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তিনিই আমার সর্বাধিক আপন, সবচেয়ে কাছের । আমি আমার যতটা কাছে, তারচয়েও বেশি সন্নিকটে মহান আল্লাহ। আমি নিজেকে ভালোবাসি যতটা, ততোধিক ভালো তিনি আমাকে বাসেন—এটা কি আমরা বিশ্বাস করি? অনুভব করি হৃদয় দিয়ে?

রবের কাছে যেতে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগে না, প্রয়োজন পড়ে না মধ্যস্থতার। কোনোরূপ মাধ্যম ব্যতিরেকেই তিনি আমাদের ডাকে সাড়া দেন প্রতিমুহূর্তে। তিনি সকল কিছু দেখেন, শোনেন ও জানেন। তিনি তো অন্তর্যামী! আমরা তাঁর সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্য পেতে যতটা না আগ্রহী, তারচেয়ে বেশি উদ্‌গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেন তিনি। আমরা একটু আগালে তিনি এগিয়ে আসেন অনেক দূর। মায়া ও মমতার স্পর্শে কাছে টেনে নেন প্ৰিয় বান্দাদের, আগলে রাখেন অফুরান দয়ার বাঁধনে।

Home Shop Cart Account