
রাসূল -এর সুস্বাস্থ্যের পেছনে সবচেয়ে বড়ো নিয়ামক ছিল উত্তম খাদ্যাভ্যাস। তিনি ছিলেন পরিমিত ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত । কখনো উদর পূর্তি করে খেতেন না । পেটকে আনুমানিক তিন ভাগ করে এক ভাগের জন্য খাবার খেতেন, আরেক ভাগ পানি দ্বারা পূর্ণ এবং অপরভাগ খালি
রাখতেন সব সময়।
রাসূল অল্পই খেতেন, কিন্তু তা খেতেন উপভোগ করে। খাবার নষ্ট করতেন না কখনো। বড়ো থালা ব্যবহার করতেন, যেন খাবার মাটিতে না পড়ে। কোনো কারণে খাবার পড়ে গেলে তা পরিচ্ছন্ন অবস্থায় তুলে খাওয়ার জন্য ব্যবহার করতেন চামড়ার দস্তরখান। থালায় কোনো খাবার ফেলে রাখতেন না; এমনকী আঙুলে লেগে থাকা খাবারের অবশিষ্ট অংশও চেটে খেতেন । আনাস (রা.) বর্ণনা করেন—
‘নবিজি খাবার খেলে তাঁর তিন আঙুল চেটে খেতেন। আর বলতেন—“তোমাদের কারও নলা পড়ে গেলে সে যেন তা শয়তানের জন্য ফেলে না রাখে; বরং ধুয়ে খেয়ে ফেলে । আর চেটে খায় যেন থালাটিও। কারণ, তোমরা তো জানো না, খাবারের কোন অংশে বরকত রয়েছে।”” (মুসিলম : ৬০৮ )
খাবার শেষে আঙুল চেটে খাওয়ার সুন্নত থেকে চিকিৎসাবিদগণ একটি চমৎকার তথ্য বের করেছেন। এ সময় মুখের ভেতর সেলিভারি গ্ল্যান্ড (Salivary Gland) থেকে টায়ালিন (Ptyalin) নামক একপ্রকার পাচক রস বের হয়। পাকস্থলী থেকে শিষণ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বেই এটি প্রায় সব খাবার অর্ধেক হজম করে ফেলে ।
রাসূল খুবই পরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার গ্রহণ করতেন। খাওয়ার পূর্বে দুই হাতের কবজি পর্যন্ত ধুয়ে নিতেন। সর্বদা খাবার গ্রহণ করতেন ডান হাত দিয়ে। কারণ, ডান হাত বাম হাত অপেক্ষা অধিকতর পবিত্র ও উত্তম। তা ছাড়া ডান হাতে খাওয়া রুচিসম্মতও বটে। তিনি খাবারে কখনো ফুঁ দিতেন না। এটা ছিল তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও খাবারে ফুঁ দিতে নিষেধ করে। কারণ, ফুঁ দিলে মুখ থেকে নির্গত কার্বন ডাই- অক্সাইড খাবারে মিশে যায়, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
কোনো কিছুর ওপর হেলান দিয়ে খাবার খেতে তিনি নিষেধ করেছেন। হেলান দিয়ে খাদ্য গ্রহণের ফলে পেট বড়ো হয়ে যায়। এতে খাবার গলায় আটকে যেতে পারে অথবা শ্বাসনালিতে ঢুকে যেতে পারে। তা ছাড়া এটা দাম্ভিকতার আলামতও বটে। আবু হুজাইফা (রা.) বর্ণনা করেন—
‘আমি রাসূল -এর দরবারে ছিলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে বললেন—“আমি ঠেস লাগানো অবস্থায় কোনো কিছু ভক্ষণ করি না।”” (বুখারি : ৫১৯০, তিরমিজি : ১৯৮৬)
নবি করিম বালিশে বিশ্রাম নেওয়া অবস্থায়ও কখনো খাবার খেতেন না । তিনি তিন আঙুল দিয়ে খাবার উঠিয়ে ছোটো ছোটো লোকমায় খাবার খেতেন। একদমই তাড়াহুড়ো করতেন না। এতে ভালো করে চিবিয়ে খাওয়ার সুযোগ পেতেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে—উত্তমরূপে চিবিয়ে খেলে খাবার ভালোভাবে চূর্ণ হয়। ফলে খাবারের যাবতীয় পুষ্টি শরীর সহজেই শোষণ করতে পারে। তা ছাড়া চিবিয়ে খেলে খাবার অপেক্ষাকৃত বেশি সময় মুখে থাকে। এতে খাবারের মধ্যকার স্নেহ ও চর্বিজাতীয় পদার্থ দ্রুত হজম হওয়ার সুযোগ পায়। খাবার দীর্ঘক্ষণ চিবিয়ে খেলে মস্তিষ্ক অল্পতেই তৃপ্ত হয়। ফলে অতি ভোজনের সম্ভাবনাও কমে যায় ৷
বিশেষজ্ঞগণ বলেন—ভালোভাবে চিবিয়ে খেলে খাবার মুখের লালার সাথে মিশ্রিত হয়। মানুষের মুখের লালায় ‘সালিভারি অ্যামায়লেস’ নামক একধরনের অ্যানজাইম থাকে, যা খাবার ভালোভাবে হজম করতে সাহায্য করে। এতে গ্যাসট্রিকসহ পেটের বিভিন্ন সমস্যা থেকে নিরাপদ থাকা যায় ৷ অন্যদিকে ভালো করে চিবিয়ে না খেলে খাবার লালার সঙ্গে ভালোভাবে মেশার সুযোগ পায় না। ফলে শরীরে অপ্রয়োজনীয় বায়ু প্রবেশ করে এবং গ্যাসট্রিক ও হজমে সমস্যা তৈরি হয়।
ডেন্টিস্টরা বলেন—খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খেলে দাঁত ও দাঁতের মাড়ি শক্ত হয়। সঠিকভাবে চিবানোর ফলে মুখ থেকে নিঃসৃত স্যালাইভা দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাদ্যাংশ পরিষ্কার করে। এতে দাঁতের সমস্যা কমে যায়, দাঁত হয় মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী।
রাসূল সাধারণত একা খেতেন না; কখনো পরিবারের লোকজন, কখনো আহলে সুফফা বা অন্য সাহাবিগণ তাঁকে সঙ্গ দিতেন। এতে আনন্দঘন ও বৈঠকি পরিবেশে তাঁর খাদ্য গ্রহণ সম্পন্ন হতো। তিনি কখনো খাবারের দোষত্রুটি ধরতেন না। পছন্দ হলে খেতেন, নচেৎ এড়িয়ে যেতেন নিঃশব্দে ।
রাসূল রুটিন মেনে খাদ্য গ্রহণ করতেন। প্রতিদিন ফজরের নামাজান্তে সূর্যোদয়ের পর বাড়িতে ফিরে স্ত্রীদের জিজ্ঞেস করতেন— কোনো খাবার আছে কি না। থাকলে খেতেন, না থাকলে বলতেন—’আমি রোজার নিয়্যাত করলাম।’ দুপুরের খাবার গ্রহণ করতেন জোহরের নামাজের পূর্বে। খাবার শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে জোহরের সালাত আদায় করতেন। আসরের সালাতের পর তিনি স্ত্রীদের ঘরে যেতেন এবং মধু ও মিষ্টান্নজাতীয় খাবার খেতেন। আর রাতের খাবার খেতেন এশার সালাতের পূর্বে। এরপর এশার সালাত ও কিয়ামুল লাইল করে ঘুমিয়ে যেতেন ।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান রাসূল -এর অনুরূপ সময়ে খাদ্যগ্রহণের পরামর্শ দেয়। রাসূল রাতে খেয়েই শুয়ে পড়তেন না; বরং কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতেন। এতে খাবার হজম হয়ে যেত সহজেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানও এই পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দেয়। চিকিৎসকগণ বলেন—রাতে খাওয়ার পরপরই শুয়ে পড়লে খাবারের অ্যাসিডিটি পরিপাকতন্ত্রের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে হজমে বিঘ্নতা ঘটে; দেখা দেয় ক্ষুধামন্দা, বদহজম, গ্যাস্ট্রিকসহ পরিপাকতন্ত্রের নানাবিধ জটিলতা ।