
কখনো কি বিজন অন্ধকারে রবের পানে মুখ তুলে বলেছেন-‘দয়াময় প্রভু! প্রাণাধিক ভালোবেসেছি তোমায়! ঝলমলে জ্যোৎস্নার আলো গায়ে মেখে কখনো কি খুঁজেছেন রহমতের সুধা অনুভব করেছেন কি কদর রাতে শান্তির সমীরণ? ভেবে দেখেছেন কি-এই যে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস প্রকম্পিত হচ্ছে, ধমনিতে রক্ত বইছে আপন ধারায়, নিয়ম মেনে সংকুচিত ও সম্প্রসারিত হচ্ছে মস্তিষ্কের অসংখ্য সূক্ষ্ম নিউরন, আপনার প্রতিটি স্পর্শ কিংবা উপলব্ধি-_সবই মহান রবের অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ! আপনার সামগ্রিক অস্তিতই মহান রবের অনিঃশেষ রহমত ও ভালোবাসার জ্যোতির্ময় নিরর্শন!
তিনি তো সেই রব, যিনি আমাদের ক্ষমা করার জন্য মুখিয়ে থাকেন; অথচ কী নির্বোধ আর হতভাগা আমরা! মহান রবের দরবারে সক্ষমাপ্রার্থনার ফুরসতই পাই না। লাগাতার লিপ্ত থাকি নানাবিধ পাপাচারে। এতৎসত্বেও তিনি আমাদের অক্সিজেন বন্ধ করে দেন না। এমনকী বন্ধ কামরায় নিভৃতে যখন গুনাহ ও নাফরমানিতে লিপ্ত হই, তখনও দরজার ফাঁক গলে অক্সিজেন সরবরাহ করে আমাদের বীচিয়ে রাখেন তিনি। আমরা তাঁকে ভুলে থাকি হররোজ, কিন্তু ক্ষণিকের জন্যও তিনি ভুলেন না আমাদের । আমরা মুখ ফিরিয়ে নিলেও তিনি পরম মমতায় কাছে ডেকে বলেন-‘আমার দিকে এক পা এগিয়ে এসো, তোমার দিকে দুই পা এগিয়ে যাব আমি ।’ শেষ রাতের নিস্তব্ধতায় শাস্ত-নিবিড় আবহে যে মহান প্রভু বান্দার দিকে য্নেহের বাহু বাড়িয়ে আহ্বান করেন-‘কে আছ এমন, আমার কাছে চাইবে? আমি তোমায় সব দিয়ে দেবো!’ সেই রব থেকে আমরা কতই-না বিমুখ! তার ক্ষমার স্বরূপ এমনই যে, আমরা অনুতাপ বা অনুশোচনায় বিলম্ব করি; কিন্তু তিনি ক্ষমা করতে বিলম্ব করেন না।
কত আদরে-যতনে আমাদের তৈরি করেছেন আল্লাহ! ধুলোবালি থেকে নিরাপদ রাখতে চোখের ওপর দিয়েছেন স্বয়ংক্রিয় পর্দা, তককে করেছেন মসৃণ ৷ অতিরিক্ত আলোয় যেন কষ্ট না পাই, সেজন্য চোখের ওপর দুই দ্র দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন। নাকে যেন ধুলো না ঢোকে, সেজন্য তার ভেতরে নেটের ব্যবস্থা করেছেন ছোটো ছোটো লোম দিয়ে । পায়ের পাতা পুরু করেছেন, যেন পথ চলতে কষ্ট না হয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানোর জন্য রিজিক হিসেবে পৃথিবীতে দিয়েছেন অসংখ্য নিয়ামত গাছপালা, তরুলতা দিয়ে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেছেন আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস চলমান রাখার জন্য। সৌন্দর্যে চোখ জুড়ানোর জন্য প্রকৃতিকে সাজিয়েছেন ফুলে-ফুলে। তাতে মোহনীয় সুবাসের গন্ধ দিয়েছেন মিষ্টতায় হৃদয় ভরিয়ে দিতে রেণুর মাঝে সৃষ্টি করেছেন মধুর বিন্দু । ফুলের মিলনমেলায় পাঠিয়েছেন রসিক ভ্রমর। অপরূপ দৃশ্যে ভরিয়ে তুলেছেন চারপাশ, যেন সতেজ হৃদয়ে ওঠে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ গুঞ্জন, জাগরিত হয় “আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি।
কিন্তু কী দুর্ভাগ্য আমাদের! যে রব সদা কাছে টানতে আগ্রহী, আমরা তার থেকেই দূরে পালিয়ে বেড়াই অহর্নিশ। যিনি আমাদের জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, আমরা তার থেকেই মুখ ফিরিয়ে রাখি। শুধু তা-ই নয়; অজ্ঞতা, অবাধ্যতা, হঠকারিতা আর অহংকারের মাধ্যমে চোখের সামনে এমন এক দুর্ভেদ্য পর্দা তৈরি করে ফেলি, যা আল্লাহর নৈকট্যকেই আড়াল করে ফেলে। একপর্যায়ে ভুলেই যাই মহামহিম রবকে; ভুলে যাই সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার অনস্বীকার্য সম্পর্ক । কখনো কখনো স্রষ্টার অস্তিতৃকেই অস্বীকার করে বসি অথবা তার সমতুল্য ভাবা শুরু করি অন্য কাউকে । এতে অবাধ্যতার পর্দা কেবল পুরুই হতে থাকে। ফলে সৃষ্টার আহ্বান আর আমাদের কান পর্যন্ত পৌছায় না। বিচ্ছিন্ন হয় রবের সঙ্গে বান্দার নিবিড় যোগাযোগ আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বান্দার চূড়ান্ত সফলতা । আর রবের নৈকট্য অর্জনের জন্য প্রথমেই তার অবাধ্যতা থেকে সরে আসতে হবে। একই সঙ্গে বিরত থাকতে হবে সমস্ত নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড থেকে তার বিধানসমূহ পালনে হতে হবে অধিকতর যত্নশীল । অতঃপর আনুগত্যের শির নত করে আল্লাহ ও আমাদের মধ্যকার কৃত্রিম পর্দাকে ভেদ করতে হবে। অনুশোচনা ও ইস্তেগফার মেশানো চোখের পানি সেচে এগিয়ে নিতে হবে নৈকট্যের তরণি ।