Shopping Cart
৳ 0.00

No products in the cart.

আহ্বান: ড. মিজানুর রহমান আজহারি

দেহাবরণ

পরিবার মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনের মধ্য দিয়েই এর সূচনা। এই বন্ধন সুদৃঢ় হলে দাম্পত্য সম্পর্কে প্রবাহিত হয় প্রশান্তির নির্মল বাতাস, পরিবার পরিণত হয় শান্তির নীড়ে। অন্যদিকে এই বন্ধন ঢিলে হলে পুরো পরিবারই এলোমেলো হয়ে যায়। তাই দাম্পত্যজীবনকে প্রশান্তিদায়ক ও উপভোগ্য রাখার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেছে ইসলাম। দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য ইসলাম এমন সব নীতিমালা উপহার দিয়েছে, যার পূর্ণ অনুসরণে স্বামী-স্ত্রী দুজনের সম্পর্ক হয়ে উঠবে গভীর ও হৃদ্যতাপূর্ণ ।

স্বামী-স্ত্রী একটি অঙ্কুরিত চারাগাছের জোড়া পল্লবের মতো; যার অস্তিত্ব ভিন্ন, কিন্তু মূল এক ও অভিন্ন। এই দুই কিশলয়ের ঘনিষ্ঠ যাত্রায় একদিন তা পরিণত হয় শত পল্লববিশিষ্ট বৃহৎ বৃক্ষে। একসময় তার ঘন ছায়ায় আশ্রয় নেয় পরবর্তী প্রজন্মের খালিদ, উমর ও সুমাইয়ারা। আল্লাহ তায়ালা বলেন—

وَمِنْ ايْتِهَ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ اَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

‘তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। অবশ্যই এর মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে ।’

(সূরা রূম : ২১)

الَّذِي خَلَقَكُمْ مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا –

‘তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে। আর সেই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া।’ (সূরা নিসা : ১)

মানবেতিহাসের প্রথম নারী হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল তাঁর স্বামী আদম (আ.)-এর পাঁজরের হাড় থেকে। অর্থাৎ, সৃষ্টিসূত্রেই তাঁরা একে অপরের দেহাংশ। এজন্যই স্ত্রীকে বলা হয় অর্ধাঙ্গিনী, আর স্বামীকে অর্ধাঙ্গ । প্রকৃতপক্ষে জীবনসঙ্গিনীকে ছাড়া একজন ব্যক্তির দ্বীনও অপূর্ণ থেকে যায় । রাসূল বলেছেন—

‘বান্দা যখন বিবাহ করে, তখন সে নিজের অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করে। অতএব, বাকি অর্ধেকাংশে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।’ (আল জামিউস সগির : ৬১৪৮ )

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এতটাই নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ যে, এর উপমায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেন—

هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ –

‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরাও তাদের পোশাক।’ (সূরা বাকারা : ১৮৬)

সুবহানাল্লাহ! এর চেয়ে সুন্দর ও যৌক্তিক উপমা আর কী হতে পারে! এটি শুধু স্বামী-স্ত্রীর সৌন্দর্যকেই প্রকাশ করে না; বরং তাদের অন্তরঙ্গতা, অপরিহার্যতা, গুরুত্ব, দায়িত্ব ইত্যাদিকেও ফুটিয়ে তোলে চমৎকারভাবে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য ঠিক কেন পোশাকের মতোই অপরিহার্য অনুষঙ্গ, পোশাকের গুণাবলি ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করলেই সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে—

সৌন্দর্যবর্ধনকারী : পোশাক মানুষের সৌন্দর্যবর্ধন করে, ব্যক্তির রুচিবোধ ও চারিত্রিক মর্যাদাকে ফুটিয়ে তোলে সকলের সামনে। একইভাবে যোগ্য দাম্পত্যসঙ্গী জীবনে এনে দিতে পারে বর্ণিল রঙের ছটা। ভালোবাসার আবিরে রাঙিয়ে দেয় হৃদয়ের জমিন। সঙ্গিনী যোগ্য, কর্মঠ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও পরহেজগার হলে অন্যের নিকট তার মর্যাদা বেড়ে যায় বহুগুণে। সঙ্গীর হৃদয়ে প্রবাহিত হয় সুখানুভূতির মৃদুমন্দ হাওয়া। আর মনের এই সৌন্দর্যই একসময় প্রতিফলিত হয় তার চিন্তা ও কর্মে ।

নিকটতম বস্তু : পোশাক মানুষের সবচেয়ে কাছের বস্তু। সর্বদা শরীরের সাথে লেগে থাকায় দেহ আর পোশাকের মধ্যে কোনো আড়াল বা পর্দা অবশিষ্ট থাকে না। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, মানুষ চেষ্টা করে নিজেকে সর্বদা পোশাকের সাথে জড়িয়ে রাখতে। অসাবধানতায় পোশাক আপন জায়গা থেকে সরে গেলে তা ঠিক করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। আদর্শ স্বামী- স্ত্রীও ও অনুরূপ। তারা পরস্পরের সবচেয়ে নিকটজন। উভয়ের মাঝে নেই কোনো পর্দা, নেই কোনো ব্যবধান । শত বাধা-বিপত্তি মাড়িয়ে তারা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে থাকে। বেখেয়ালে যদি কখনো দূরত্ব তৈরি হয়েই যায়, গোচর হওয়ামাত্রই সঙ্গীকে কাছে টেনে নেয় পরম আদরে। বেঁধে নেয় ভালোবাসার মিষ্টি-মধুর অনুরাগে ।

দুর্বলতা আচ্ছাদনকারী : পোশাক মানুষের যাবতীয় অসুন্দর ও কুৎসিত রূপ ঢেকে রাখে। গোপন রাখে দৃশ্যমান সকল শারীরিক দুর্বলতা। নিশ্চিত করে লজ্জাস্থানের নিরাপত্তা। স্বামী-স্ত্রীর জন্যও অনুরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়। তারা পরস্পরের যাবতীয় গোপনীয়তাকে রক্ষা করবে। দোষত্রুটি ঢেকে রাখবে। সঙ্গীর রূপ-সৌন্দর্য অপরের নিকট বলে বেড়ানো থেকে বিরত রাখবে নিজেকে । কেননা, ইসলামের দৃষ্টিতে এটা জঘন্য অপরাধ। রাসূল বলেন—

‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড়ো খেয়ানতকারী ও নিকৃষ্টতম বিবেচিত হবে ওই ব্যক্তি, যে নিজ স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর স্ত্রীর গোপনীয়তা অন্যের নিকট ফাঁস করে দেয়।’ (মুসলিম : ১৪৩৭ )

আদর্শ যুগল আপন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর চারিত্রিক দুর্বলতাকে গোপন রাখবে এবং আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবে তা শুধরে ফেলার। একই সঙ্গে বৈধ উপায়ে একে অন্যের যাবতীয় চাহিদা মিটিয়ে লজ্জাস্থানকে সুরক্ষিত রাখবে সকল প্রকার পাপাচার থেকে।

ক্ষতিকর বস্তু থেকে হেফাজতকারী : পোশাক মানুষকে বাইরের বিভিন্ন ক্ষতিকর বস্তু থেকে রক্ষা করে। দেহকে পরিচ্ছন্ন রাখে ধুলো-বালি-ময়লা থেকে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় উষ্ণতা দেয়, প্রখর খরতাপে দেয় সুরক্ষা। একইভাবে স্বামী-স্ত্রীও আপন সঙ্গীকে চোখের পাপ থেকে হেফাজতে রাখে। নফসের লাগাম টেনে দমন করে কুপ্রবৃত্তির অদম্য চাহিদা ।

ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক : পোশাক অনেক সময় ব্যক্তির জাতীয় ও পেশাগত পরিচয় বহন করে। পোশাকের ধরন দেখলেই টের পাওয়া যায়, ব্যক্তি কোন পেশা ও ধর্মকে ধারণ করে। যেমন : ইউনিফর্ম দেখলেই বোঝা যায়- ব্যক্তি ডাক্তার, আইনজীবী, পুলিশ নাকি আলিম। পোশাক ব্যক্তির পরিচয় ও মর্যাদা সম্পর্কে অন্যের নিকট সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেয়। দম্পতি যুগলের অবস্থাও অনুরূপ। তারা পরস্পরের পরিচয় ও ইজ্জতের প্রতিনিধিত্ব করে। স্ত্রীর নেতিবাচক গুণ বা আচরণের কারণে স্বামীর সম্মানহানি হয়; আবার স্বামীর মন্দ কর্মকাণ্ড আঁচড় ফেলে স্ত্রীর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বে। অনুরূপ একজনের মহৎ গুণ ও সাফল্যে দুজনেরই মুখ উজ্জ্বল হয় ।

পর্দার বিধান নাজিলের পূর্বে রাসূল -এর পবিত্র স্ত্রীগণ কখনো কখনো মদিনার আর দশজন সাধারণ মহিলার মতোই ঘরের পোশাকে বাইরে বের হতেন; কিন্তু রাসূল -এর স্ত্রীদের জন্য এটা মোটেই মানানসই ছিল না । ফলে আল্লাহ তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন—’তোমরা রাসূলের স্ত্রী। সাধারণ নারীদের মতো এভাবে বের হওয়া তোমাদের মর্যাদার বিপরীত।’ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে—

يُنِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا ۖ وَقَرْنَ

في بُيُوتِكُن وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولى –

‘হে নবির স্ত্রীগণ! তোমরা সাধারণ নারীদের মতো নও। যদি আল্লাহকে ভয় করে থাকো, তাহলে তোমরা কোমল স্বরে কথা বলো না, যাতে অন্তরে ব্যাধি রয়েছে—এমন কোনো ব্যক্তি প্রলুব্ধ হয়ে পড়ে; বরং পরিষ্কার, সোজা ও স্বাভাবিকভাবে কথা বলো। নিজেদের গৃহের মধ্যে অবস্থান করো এবং পূর্বের জাহেলি যুগের মতো সাজসজ্জা দেখিয়ে বেড়িয়ো না।’

(সূরা আহজাব : ৩২-৩৩)

মানুষ স্বভাবতই প্রত্যাশা করে, ব্যক্তির মর্যাদা তার সঙ্গিনী বা সঙ্গীর ওপরও পড়ুক। তাই দম্পত্তির কর্তব্য হলো—পরস্পরের উত্তম গুণাবলি ও মর্যাদা রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট থাকা ।

Home Shop Cart Account