Shopping Cart
৳ 0.00

No products in the cart.

আহ্বান: ড. মিজানুর রহমান আজহারি

পোশাকের মর্যাদা

আল্লাহ তায়ালা স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের পোশাক বলে অবিহিত করেছেন। তিনি বলেননি কেবল স্বামীর পোশাক স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর পোশাক স্বামী; বরং বলেছেন, দুজনইে দুজনের একান্ত ভূষণ। কেননা, পোশাক যেমন মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, তেমনই স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মর্যাদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে তাদের পারস্পরিক কর্মকাণ্ড।

পৃথিবীর যত মানুষ বিখ্যাত হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশের পেছনেই রয়েছে জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীর অবদান; হোক সে প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন। রাসূল -এর নবুয়তের কঠিন দায়িত্ব পালনে যে মানুষগুলো পাশে থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন—উম্মুল মুমিনিন খাদিজা, আয়িশা ও উম্মে সালামা (রা.)সহ তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ । খাদিজা (রা.) নিজের সমস্ত সম্পত্তি স্বামীর মহান দায়িত্ব পালনে অর্পণ করেছেন; কাছে থেকে সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন আজীবন। স্বামীর জন্য নিয়মিত খাবার বহন করে নিয়ে গেছেন প্রায় দুই হাজার ফুট উঁচু হেরা পর্বতের গুহায়। প্রথম ওহি নাজিলের সময় নবিজি নিজেই যখন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, এই মহীয়সী নারীই তখন সাহসের মশাল জ্বেলে স্বামীকে বলেছিলেন—

“আপনি বিচলিত হবেন না । আল্লাহ কখনোই আপনাকে অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। অভাবগ্রস্তদের অভাব মোচনের চেষ্টা করেন। অসহায়দের আশ্রয় প্রদান করেন। মেহমানদের আদর-আপ্যায়ন করেন এবং ঋণগ্রস্তদের ঋণ মোচনে সাহায্য করেন। নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে অপদস্থ করবেন না।’ (বুখারি : ৬৯৮২)

হুদাইবিয়ার সন্ধির পর আপাত পরাজয় বিবেচনায় সাহাবিদের মন যখন বিষাদের কালো মেঘে আচ্ছন্ন, তখন রাসূল প্রত্যেককে বললেন মাথা মুণ্ডন করতে; কিন্তু কেউ-ই সম্মত হতে পারছিলেন না তাতে। এমন থমথমে ও গম্ভীর পরিবেশে আম্মাজান উম্মে সালামা (রা.) রাসূলকে পরামর্শ দিলেন—‘আপনি নিজে আগে মাথা মুণ্ডন করুন, তাহলে আপনার দেখাদেখি সবাই সেটা করবে।’ প্রিয়তমা স্ত্রীর পরামর্শে নবিজি নিজের মাথা মুণ্ডন করলেন । এতে কাজও হলো দারুণ। এ দৃশ্য দেখে কেউ আর বসে থাকতে পারলেন না। নবিজির দেখাদেখি একে একে সবাই মাথা মুণ্ডন করে ফেললেন । হতাশার বরফ গলিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেন প্রত্যেকে ।

কোনো জটিল সমস্যায় পতিত হওয়ার পর রাসূল যদি কোনো উপায় খুঁজে না পেতেন, তবে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আয়িশা (রা.)-এর ঘরে যেতেন। আয়িশা (রা.)-এর ঘরে গেলেই আল্লাহর ইচ্ছায় ওহি নাজিল হতো আর তিনি খুঁজে পেতেন কার্যকর সমাধান। এভাবেই উম্মুল মুমিনিনগণ রাসূলুল্লাহ * -এর নবুয়তের দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন । কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন—

‘কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,

শক্তি দিয়াছে, প্রেরণা দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’

স্বামীর সফলতার পেছনে যেমন স্ত্রীর অবদান রয়েছে, তেমনই স্ত্রীদের সুখ্যাতির পেছনেও রয়েছে স্বামীর অবদান। রাসূল তাঁর স্ত্রীদের খ্যাতির পেছনে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছেন। খাদিজা (রা.)-এর বিশাল ব্যাবসা তদারকি করেছেন অসামান্য দক্ষতার সাথে। আয়িশা (রা.)-এর জ্ঞানের জোছনার পেছনে রাসূল -এর অবদান ছিল সূর্যের মতো। অন্যান্য বিখ্যাত নারীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত বলে যাকে অবিহিত করা হয়, সেই বেগম রোকেয়ার বিখ্যাত হওয়ার পেছনেও রয়েছে তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা ।

এই জন্য প্রত্যেক স্বামীর উচিত স্ত্রীকে গুরুত্ব দেওয়া, তার মানবিক মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ণ হয়—এমন আচরণ থেকে বিরত থাকা । একজন সচ্চরিত্রা স্ত্রীর মর্যাদা অনেক বেশি। সচ্চরিত্র স্ত্রী গোটা পরিবারের জন্যই রহমত ও প্রশান্তির উৎস, আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। এজন্য রাসূল

স্ত্রীকে শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে অবিহিত করেছেন । তিনি বলেন—

সচ্চরিত্র

‘এই পৃথিবীর সকল বস্তুই মূল্যবান। তবে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো—একজন নেককার বা সৎকর্মপরায়ণ স্ত্রী ।’ (নাসায়ি : ৩২৩২)

তিনি আরও বলেন—

‘চারটি বস্তু সৌভাগ্যের নিদর্শন : পুণ্যবতী স্ত্রী, প্রশস্ত বাড়ি, সৎ প্রতিবেশী ও আরামদায়ক বাহন। আর চারটি বস্তু দুর্ভাগ্যের নিদর্শন : মন্দ স্ত্রী, সংকীর্ণ বাড়ি, মন্দ প্রতিবেশী ও মন্দ বাহন । (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৪০৩২ )

রাসূল স্ত্রীদের কাচের গ্লাসের সাথে তুলনা করেছেন, তাদের আগলে রাখতে বলেছেন মায়ার বাঁধনে। কাচের সামগ্রীকে সব সময় একটু নিরাপদ জায়গায় রাখতে হয়। একটু বেশিই যত্ন করতে হয়। নাড়াচাড়া করতে হয় খুব সতর্কতার সাথে, যাতে অসাবধানতাবশত পড়ে গিয়ে চুরমার না হয়ে যায়। নারীরাও কাচের মতো ভঙ্গুর। পলিমাটির মতো কোমল তাদের হৃদয়। একটু এদিক-সেদিক হলেই তারা ভীষণ আঘাত পায়। দুষ্টু লোকের বদনজরও সদা নিবদ্ধ থাকে তাদের ওপর। তাই নারীদের জন্য একটু নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করতে হয়, কথা বলতে হয় অনুচ্চস্বরে, বিগলিত হৃদয়ে। রাসূল বলেন-

‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম । আমি আমার স্ত্রীদের নিকট উত্তম।’ (ইবনে মাজাহ : ১৯৭৭)

এই হাদিস আমাদের দুটো বিষয় সম্পর্কে অবগত করে। প্রথমত, ইসলাম স্ত্রীদেরকে এত বেশি মর্যাদা দিয়েছে যে, তাদের বক্তব্য বা স্বীকৃতিকেই বিবেচনা করা হয়েছে স্বামীর চারিত্রিক সনদ হিসেবে। কারণ, স্বামীর স্বভাব- চরিত্র ও অভ্যাস সম্পর্কে সাধারণত স্ত্রীরাই বেশি অবগত। দ্বিতীয়ত, স্বামীর উচিত স্ত্রীদের সাথে এমন উত্তম আচরণ করা, যাতে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বামীকে উত্তম বলে স্বীকৃতি দেয়। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, স্ত্রীর কাছে ভালো হতে গিয়ে যেন মা-বাবা এবং অন্যদের প্রতি জুলুম না হয়ে যায়। পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের সাথে সদ্‌ব্যবহার ও সুসম্পর্ক বজায় রাখাও সমরূপ জরুরি। আর এ দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করাই একজন মুমিনের কাজ ।

অন্যদিকে স্ত্রীদেরও কর্তব্য হলো—স্বামীকে যথাযথ সম্মান দেওয়া এবং তার আত্মমর্যাদাকে সমুন্নত রাখা। সৃষ্টিগতভাবেই পুরুষ মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে মর্যাদাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তারা অধিক চাপ ও দায়িত্ব বহন করে বলে মর্যাদাটা তাদের যৌক্তিক প্রাপ্যও বটে। তাই আল্লাহ তায়ালাও স্বামীকে অধিক মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি বলেন—

الرِّجَالُ قَوْمُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ –

‘পুরুষ নারীর তত্ত্বাবধায়ক এজন্য যে, আল্লাহ তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। কারণ, পুরুষ নিজের ধনসম্পদ ব্যয় করে।’ (সূরা নিসা : ৩৪)

স্বামীকে সম্মান ও মর্যাদা না দেওয়ার অর্থ দাঁড়ায়—স্ত্রী স্বামীকে চরম অবজ্ঞা করছে। এই অবজ্ঞা স্বামীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। ফলে অনিবার্যভাবেই স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা কমে যায়। দাম্পত্য সম্পর্কে নেমে আসে ভালোবাসাহীন এক যান্ত্রিক শুষ্কতা। তাই প্রতিটি স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর হৃদয়ে নিজের জন্য একটি জায়গা পোক্ত করে নেওয়া এবং স্বামীর মনকে সর্বদা সতেজ ও সুরভিত রাখা। কিন্তু স্বামীর মর্যাদাহানি করে এগুলো অর্জন কখনোই সম্ভব নয়। এই জন্যই রাসুলুল্লাহ এক নারী সাহাবিকে স্বামীর মর্যাদা জানিয়ে উপদেশ দিয়েছিলেন—

‘খেয়াল রেখ, তুমি স্বামীর হৃদয়ের কোথায় অবস্থান করছ। কেননা, সে-ই তোমার জান্নাত এবং সে-ই তোমার জাহান্নাম ।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৯৫১৯)

কোনো স্ত্রী যদি অন্যায়ভাবে স্বামীকে অসম্মান করে, সংগত কারণ ছাড়াই স্বামীর থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরত্ব বজায় রাখে, তাকে তুচ্ছ কারণে কষ্ট দেয়, স্বামীর স্বাভাবিক হক পূরণ থেকে বিরত থাকে এবং তার ন্যায়সংগত নির্দেশকে অমান্য করে, তবে স্বামীর প্রতি এই আচরণই হবে তার জাহান্নামের কারণ। অন্যদিকে স্ত্রী যদি আপন গুণ ও আচরণ দ্বারা স্বামীর হৃদয়ে জায়গা করে নেয়, স্বামীকে যথাযথ মর্যাদা দেয় এবং তার প্রাপ্য হক পূর্ণ করে, স্বামীর চাওয়া ও আল্লাহর হুকুমের মধ্যে সমন্বয় করে, তবে স্বামীর প্রতি এই আচরণ তাকে পৌছে দেবে পরম শান্তির আবাস জান্নাতে । স্বামীর মর্যাদার প্রতি জোর দিয়ে রাসূলুল্লাহ মুয়াজ (রা.)-কে বলেন-

‘যদি কোনো ব্যক্তিকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করার নির্দেশ দিতাম, তাহলে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম, যেন তারা নিজ স্বামীকে সিজদা করে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা স্ত্রীদের ওপর স্বামীদের বিশেষ অধিকার দিয়েছেন।’ (আবু দাউদ : ২১৪০ )

স্বামীকে স্বতঃস্ফূর্ত মনে সঙ্গ দেওয়াও স্ত্রীর অন্যতম কর্তব্য। স্ত্রী যখন স্বামীর আশেপাশে থাকে, তার সাথে খোশগল্প করে, প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখে এবং স্বামীর সাহায্যে এগিয়ে যায়, তখন স্বামী অন্তর থেকে অনেক বেশি মর্যাদা ও প্রশান্তিবোধ করেন। ফলে স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা বেড়ে যায় বহুগুণ। স্ত্রীর নিকট থেকে এতটুকু সঙ্গ ও সহযোগিতা পাওয়া স্বামীর মৌলিক অধিকার। তাই রাসুল * নারীদের নির্দেশ দিয়েছেন স্বামীকে সর্বোচ্চ সঙ্গ দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন-

‘নারীরা যদি নিজ স্বামীর হক (যথার্থভাবে) জানত, তাহলে স্বামীর দুপুর অথবা রাতের খাবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা (স্বামীর পাশে) দাঁড়িয়ে থাকত।’ (জামিউল আহাদিস : ১৯০০২)

ওপরে বর্ণিত বিভিন্ন কুরআন-হাদিসের বর্ণনাগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই কর্তব্য হলো পরস্পরকে মর্যাদা দেওয়া। পরস্পরের সম্মান-ইজ্জত-আব্রু ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একে অন্যের মানসিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখা। সর্বোপরি সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে সব সময় পাশে থাকা ।

Home Shop Cart Account