
আমরা শখের পোশাককে সব সময় চকচকে-ঝকঝকে রাখতে পছন্দ করি । সামান্য ময়লা লাগলে দ্রুত পরিষ্কার করে ফেলি। চেষ্টা করি সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর উপাদানটি বেছে নিতে। দাম্পত্য সম্পর্কের সজীবতা ধরে রাখার জন্যও এমন মনোভাব প্রয়োজন। আমাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর মাঝে কোনো প্রকার মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে দ্রুততার সাথে এবং অধিকতর কার্যকর উপায়ে তা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। দাম্পত্য সম্পর্কে অজান্তেই কোনো আবর্জনা প্রবেশ করল কি না, সেই ব্যাপারেও প্রত্যেকের সচেতনতা জরুরি ।
পুরুষ ও নারী সৃষ্টিগতভাবেই ভিন্ন প্রকৃতির। তাদের মানসিক অবস্থা ও চাওয়া-পাওয়াও ভিন্ন । ফলে এই দুই ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ যখন একই বাহনে সহযাত্রী হয়ে পথ চলতে চায়, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের বোঝাপড়াকে নিত্য ঝালিয়ে নিতে হয়, খেয়াল রাখতে হয় পরস্পরের সুযোগ-সুবিধার প্রতি। সম্পর্কের কোথাও ভঙ্গুরতা দেখা দিলে সেটাকে তৎক্ষণাৎ মেরামত করতে হয় আন্তরিক যত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে ।
ভিন্ন প্রকৃতির দুটি মনকে একই ধ্যানে পরিচালিত করতে কিছু নিয়ম অনুসরণ খুবই জরুরি। এগুলো সম্পর্কের মাঝে অনুরক্তির পবিত্র জোয়ার আনে। বর্ধিত করে মোহনীয় অনুভূতির ঝিরিঝিরি বারিধারা। সম্পর্ককে করে তোলে আরও উপভোগ্য ও প্রাণবন্ত। দাম্পত্যজীবনে নিয়ে আসে শান্তির বার্তা । সেই সর্বজনীন নিয়মগুলো এবার জেনে নেওয়া যাক—
সমঝোতা : দাম্পত্য সম্পর্ক জীবনব্যাপী এক যুগপৎ পরিভ্রমণের নাম। নিত্যনতুন বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি হতে হয় এ সফরযাত্রায়। জয় করতে হয় অসংখ্য পাওয়া না পাওয়ার টানাপোড়েন। বিবাহের মাধ্যমে দুজন অজানা-অচেনা মানুষ যুগলবন্দি হয়ে এক নতুন সম্পর্কের সূচনা করে। তাদের মধ্যে থাকে পছন্দ, অভ্যাস, চিন্তা ও মতের ভিন্নতা। থাকে ব্যবহারিক বিষয়াদি ও রীতিনীতির পার্থক্য ।
ভিন্ন পরিবারের, ভিন্ন এলাকার; এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন সংস্কৃতির দুজন স্বাধীন মানুষ যখন একই বিন্দুতে একীভূত হতে চায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই আবশ্যক হয়ে পড়ে পারস্পরিক সমঝোতা। তা না হলে অসন্তোষের কালো মেঘ জমে ওঠে দাম্পত্যজীবনে। নষ্ট হয়ে যায় সংসারের রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ। সুতরাং দাম্পত্যজীবন মাধুর্যতা ধরে রাখার জন্য সমঝোতার বিকল্প নেই ।
স্ত্রীর সব আচরণ ও বৈশিষ্ট্য স্বামীর নিকট পছন্দনীয় হবে কিংবা স্বামীর সব অভ্যাস স্ত্রীর নিকট ভালো লাগবে—এমনটা হওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ, মানুষকে আল্লাহ তায়ালা ভিন্ন পছন্দ ও বৈশিষ্ট্য দিয়েই তৈরি করেছেন। এই ভিন্নতার মাঝে সমন্বয় করাই সঙ্গীর কাজ। কোনো মানুষই নির্ভুল ও সর্বেসর্বা নয়। প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু ঘাটতি ও মন্দ স্বভাব রয়েছে। আছে ভালো গুণের সমাবেশও; ভালো-মন্দ মিলেই তো মানুষ । আদর্শ দম্পতির কাজ হলো—সঙ্গীর ভালো গুণকে নিজের মধ্যে ধারণ করে মন্দগুণ অপসারণে প্রচেষ্টা চালানো। সেইসাথে বিভিন্ন সমস্যা-সংকটকে সহজভাবে নেওয়া এবং ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা রাখা। সমঝোতার সংজ্ঞা মোটামুটি এমনই ।
সমঝোতার জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই একগুঁয়েমি মনোভাবের ঊর্ধ্বে ওঠা জরুরি। বিপরীত সঙ্গীর কাছে যা অপছন্দনীয়, তা যদি সত্যিই মন্দ হয়ে থাকে, তবে সংশোধনের প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। গোঁ ধরে বসে থেকে উলটো সঙ্গীকেই সেই বদগুণে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য চাপ দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। আর যদি সেটা মন্দ না হয়ে নিছক পছন্দের ভিন্নতা হয়ে থাকে, তবে দাম্পত্যসঙ্গীকে পছন্দের কারণ ব্যাখ্যা করে বোঝানো উচিত । সঙ্গীরও উচিত বিপরীতজনের পছন্দকে সম্মান জানিয়ে তা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা; যদি তা ক্ষতিকারক না হয় ।
ধরুন, স্ত্রী মেকআপ করে বাইরে সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পছন্দ করেন। এটা তার খুবই প্রিয় শখ, কিন্তু স্বামী এতে আপত্তি তুললেন। এক্ষেত্রে স্ত্রীকে বিবেচনা করতে হবে, স্বামীর আপত্তির বিষয়টি সত্যিই মন্দ কর্ম কি না। ইসলামের দৃষ্টিতে অবশ্যই এটি মন্দ কর্ম। কারণ, আল্লাহ কুরআনে সুস্পষ্টভাবে নারীদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে বাইরে চলাফেরা করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং স্ত্রীকে নিজের এই অভ্যাস ও মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। একইভাবে ধরুন, স্বামী ধূমপান করেন এবং এটা তার পছন্দের বিষয়। স্ত্রী এতে আপত্তি তুললেন। এক্ষেত্রে স্বামীরও কর্তব্য হলো- আসলেই বিষয়টি খারাপ কি না, তা যাচাই করে দেখা। যেহেতু ধূমপান ক্ষতিকর, তাই তাকে এই অভ্যাস পরিবর্তনের প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। আর সঙ্গী আপত্তি না তুললেও মন্দ কাজ তো এমনিতেই পরিত্যাজ্য।
যদি এমন হয়, সঙ্গীর আপত্তির বিষয়টি বৈধ; কিন্তু তা অপরজনের অধিকার হরণ করে, তবে আপাত দৃষ্টিতে ভালো কর্ম বিবেচিত হলেও সেটি পরিহার করা উচিত। ধরুন, স্ত্রী সারাক্ষণ তার বান্ধবীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বা চ্যাটিং করতে পছন্দ করেন; এমনকী স্বামী ঘরে এলেও। স্বামী এতে আপত্তি তুললেন। স্বাভাবিকভাবে বান্ধবীদের সাথে ফোনে কথা বলা অবৈধ নয়, কিন্তু সারাক্ষণ এই কাজে মগ্ন থাকলে স্বামীর অধিকারে আঁচড় পড়ে। স্বামীর মৌলিক অধিকার হলো—তিনি স্ত্রীর সাথে আনন্দঘন সময় কাটাবেন, খোশগল্প, হাসি-ঠাট্টা করবেন; কিন্তু স্ত্রী অন্যের সাথে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকলে স্বামী এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। তাই এক্ষেত্রে স্ত্রীর কর্তব্য হলো— নিজের বৈধ অভ্যাসটিকেও পরিবর্তন করে স্বামীর সময়কে সার্থক করে তোলা। স্বামীও যদি এরূপ কর্মে অভ্যস্ত হন, যা স্ত্রীর মৌলিক অধিকার হরণ করে, তবে তার জন্যও নিজের অভ্যাস পরিবর্তন করে ফেলা জরুরি
কখনো যদি এমন হয় যে, সঙ্গীর আপত্তির বিষয়টি বৈধ কর্ম; কিন্তু তা উত্তম বা প্রশংসনীয় নয়, তবে দুজনকে আলোচনার ভিত্তিতে একটি যৌক্তিক সমাঝোতায় পৌঁছাতে হবে। এমতাবস্থায় ব্যক্তি যদি শুধু সঙ্গীর পছন্দকে সম্মান করে নিজের অভ্যাসকে পরিবর্তন করেন, তবে অবশ্যই তা প্রশংসনীয় কাজ। ধরুন, স্বামী জোরে জোরে নাক ডেকে ঘুমাতে পছন্দ করেন কিংবা উচ্চৈঃস্বরে মানুষের সঙ্গে কথা বলেন; এটা স্ত্রীর অপছন্দ। এমতাবস্থায় কাজটি বৈধ হলেও স্ত্রীর পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের অভ্যাসকে পরিবর্তন করা জরুরি।
এর বাইরে সঙ্গীর অন্যান্য পছন্দের বিষয়গুলোকেও পরস্পরের সম্মান করা উচিত। যেমন : স্বামী আলু ভর্তা পছন্দ করেন, অন্যদিকে স্ত্রীর পছন্দ শাক । একজন সাদা রং পছন্দ করেন, তো অন্যজন গোলাপি । একজন গল্প করতে পছন্দ করেন, অন্যজন চুপ থাকতে। এই ধরনের বিষয়গুলোতে পরস্পরকে স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে এই স্বাধীনতা যেন অন্যের বিরক্তির কারণ না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এগুলোর বাইরেও কিছু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক বিষয় থাকে; যেগুলোতে সাধারণত মতপার্থক্য তৈরি হয় এবং পাওয়া না-পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে। এসব ক্ষেত্রেও সমঝোতা ও মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থাকা আবশ্যক। নয়তো দাম্পত্য কলহ অনিবার্য হয়ে পড়ে। দুজনেই যদি সংশোধনের মানসিকতা লালন করে একগুঁয়েমি মনোভাব পরিহার করেন, তবে অবশ্যই তারা পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একটি সুন্দর ও সন্তোষজনক সমঝোতায় পৌছাতে পারবেন ।
যেকোনো বৈধ কাজে স্ত্রীকে বাধ্য করার অধিকার স্বামীর রয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে—আপসে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা হয়, বাধ্য করার মাধ্যমে তা অর্জন করা অসাধ্য। এজন্য এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, যার মাধ্যমে সঙ্গী নিজে থেকেই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন ।
অল্পে তুষ্টি : বিবাহের পূর্বে কিংবা পরে আমরা জীবনসঙ্গীকে নিয়ে অনেকটা আকাশকুসুম কল্পনায় বিভোর থাকি। সিনেমা ও নাটকে যেমনটা দেখে অভ্যস্ত, বাস্তব জীবনের সঙ্গীর ব্যাপারেও ঠিক তেমনটাই আশা করি । স্ত্রীর ব্যাপারে আমাদের প্রত্যাশা থাকে আকাশসম । স্বপ্নের রানি হবে পরির মতো সুন্দর, কথায় ছড়াবে মিষ্টতা, মুক্তো ঝরে পড়বে তার হাসিতে। পুরুষ আশা করে, তার স্ত্রী হবে খুবই পর্দানশীন, জ্ঞান-বুদ্ধিতে পণ্ডিতসম, কাজে-কর্মে পাকা এবং রান্নায় সবার সেরা। আর পরিবার ধনী হলে তো কোনো কথাই নেই। বিস্তর সম্পদের ভাগ পাওয়া যাবে স্ত্রীর বরাতে। এসবই নীচু মনের পরিচায়ক এবং আত্মমর্যাদাহীনতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত ।
নারীদের মনেও স্বামীর ব্যাপারে প্রত্যাশা থাকে আকাশচুম্বী। তারা সিনেমার নায়ক বা সেলিব্রেটিদের সাথে স্বামীকে মেলানোর চেষ্টা করে। কামনা করে— স্বামী হবে সুদর্শন, ভদ্র ও চনমনে। উচ্চপদের চাকরি থাকবে তার, থাকবে যথেষ্ট অর্থকড়িও। চরিত্রবান ও ঈমানদার হলে আরও ভালো।
কেউ কেউ তো এককাঠি বেশি সরেস। স্বামী দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও তাদের সমস্যা নেই। স্বামী তাদের সারাক্ষণ সময় দেবে, তাদের নিয়ে নিয়মিত ঘুরতে যাবে, শপিং করে দেবে চাহিদা ও পছন্দমাফিক। শ্বশুর-শাশুড়ির ঝামেলা থাকবে না । থাকবে না কোনো আত্মীয়স্বজনের আসা-যাওয়াও ।
এত সব কল্পনার ভিড়ে তারা ভুলেই যায়, জীবনসঙ্গী একজন মানুষ। আর মানুষের পক্ষে একসাথে এতগুলো গুণের অধিকারী হওয়া প্রায় অসম্ভব। দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালা একেক মানুষকে একেক গুণ দিয়েছেন; কিন্তু কাউকেই সর্বেসর্বা করেননি । তাই একজন মানুষের পক্ষে সব গুণে গুণান্বিত হওয়া কল্পনাবিলাস বই অন্য কিছু নয়। আর গল্প-উপন্যাস বা নাটক- সিনেমায় যা দেখানো হয়, তা নেহায়েতই লেখক ও পরিচালকের কল্পনার প্রতিফলন। পর্দার নায়ক-নায়িকারাও বাস্তব জীবনে নায়ক-নায়িকা নয়। কিন্তু মানুষ কল্পনার ফানুস উড়িয়ে ভাবে—যদি সিনেপর্দার মতো জীবন হতো তার!
দুনিয়ার এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমাদের উচিত সঙ্গীর ব্যাপারে অল্পে তুষ্ট থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা। একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে যে সমস্ত মৌলিক গুণের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন, সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখা। নিজের ও সঙ্গীর মাঝে কোনো দিকে ঘাটতি থেকে গেলে তা পূরণে পরস্পরকে সহযোগিতা করা। মনে রাখতে হবে, দুনিয়াতে মানুষের চাওয়া কখনো ফুরাবে না। যত পাবে, ততই চাইবে। এই জন্য সবার আগে নিজের সীমাহীন চাহিদার মুখে লাগাম টানতে হবে। দমন করতে হবে প্রবৃত্তির তাড়নাকে ।
দম্পতির উচিত, সঙ্গীর উত্তম গুণগুলো খুঁজে নেওয়া এবং সেগুলোকে সামনে রেখে ঘাটতিগুলোকে এড়িয়ে চলা। সুযোগ থাকলে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা, না থাকলে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সেটাকে উপভোগ করতে শেখা কিংবা ধৈর্যধারণ করা। একই সঙ্গে নিজের ঘাটতিগুলোকেও বিবেচনায় রাখা। মনে এই উপলব্ধি নিয়ে আসা—শুধু সঙ্গীর মাঝেই ঘাটতি নেই; আমার মধ্যেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। তাহলে অল্পে তুষ্ট থাকা সহজ হবে। এই ব্যাপারে রাসূল আমাদের একটি চমৎকার দুআ শিখিয়েছেন—
اَللّهُمَّ اجْعَلْنِي شَكُورًا وَاجْعَلْنِي صَبُورًا وَاجْعَلْنِي فِي عَيْنِي صَغِيرًا
وَفِي أَعْيُنِ النَّاسِ كَبِيرًا –
‘হে আল্লাহ! আমাকে সবরকারী বানাও; আমাকে শুকরিয়াকারী বানাও; আমাকে আমার চোখে ছোটো বানাও; মানুষের চোখে আমাকে বড়ো বানাও।’ (মাজমাউজ জাওয়াইদ : ১৭৪১২)
বিশ্বাস : দাম্পত্যজীবন সুখময় ও স্থায়ী হওয়ার জন্য বিশ্বাস অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ব্যতীত দাম্পত্যবন্ধন দৃঢ় হতে পারে না । সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাস মনকে প্রশান্ত ও নির্ভার রাখে, উদ্বুদ্ধ করে সম্মান- মর্যাদা ও ভালোবাসার চাদরে সঙ্গীকে জড়িয়ে রাখতে। একই সঙ্গে ব্যক্তি যখন বোঝে—বিপরীত সঙ্গীও তাকে বিশ্বাস করছে, তখন তার মনে তৈরি হয় আত্মমর্যাদার অনুভূতি। অন্যদিকে অবিশ্বাস দাম্পত্য সুখকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয় । নষ্ট করে দেয় যাবতীয় মানবিক প্রশান্তি। সুতরাং দাম্পত্য সুখ বজায় রাখার জন্য পারস্পরিক বিশ্বাস অর্জন ও রক্ষায় স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
প্রত্যেক দম্পতির উচিত এমন কর্মনীতি গ্রহণ করা, যাতে বিপরীত সঙ্গীর মনে নিজের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নেয়। দাম্পত্য সম্পর্ক এমন, যেখানে সঙ্গীর গোপন বলতে কিছুই থাকে না। সবকিছুই আস্তে আস্তে বিপরীতজনের নিকট প্রকাশিত হয়। তাই সঙ্গীর বিশ্বাস পেতে হলে শুধু বাইরে পরিপাটি হয়ে লাভ নেই; বরং ভালো হতে হবে ভেতর থেকে। চরিত্র ও অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। স্বামী বা স্ত্রী যখন বুঝবে—তার জীবনসঙ্গী সত্যি সত্যিই ভালো, তখন সে মন থেকে এমন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে, যার ভিত্তি ভাঙা প্রায় দুঃসাধ্য। এর বিপরীতটা হলে আবার সঙ্গীর মন থেকে যাবতীয় বিশ্বাস ও আস্থা উবে যাবে।
তিনি উম্মুল মুমিনিন খাদিজা (রা.)-এর সহায়-সম্পত্তি ছিল অঢেল। এই পুরো সম্পদ তিনি তুলে দিয়েছিলেন স্বামী মুহাম্মাদ -এর হাতে। কারণ বিশ্বাস করতেন, রাসূল কখনো বিপথে এই সম্পদ খরচ করবেন না নবিজি যখন নবুয়তপ্রাপ্তির ঘোষণা দেন, তখন কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তাঁর প্রতি ঈমান আনেন খাদিজা (রা.)। স্বয়ং রাসূলকেই তিনি সান্ত্বনা দেন, আশ্বস্ত করেন স্বামীর সচ্চরিত্রের সাক্ষ্য দিয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন—তাঁর স্বামীর যে চরিত্র, তা কেবল নবির সাথেই মানানসই ।
ভালোবাসা : ভালোবাসাকে কোনো শব্দমালায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কোনো নিয়মের ফ্রেমেও বাঁধা যায় না তাকে। এটি একান্ত উপলব্ধির বিষয় স্বামী-স্ত্রীর মাধুর্যময় সম্পর্কের মূল চালিকাশক্তি এই ভালোবাসা। সম্পর্কের মাঝে যখন কোনো ভালোবাসা থাকে না, তখন সেটি পরিণত হয় যান্ত্রিক অভ্যাসে। বিপরীতে দাম্পত্যজীবনে ভালোবাসার পবিত্র বাতাস প্রবাহিত হলে তাতে আর কোনো কিছুরই দরকার হয় না। পাওয়া না-পাওয়ার বেদনা সেখানে তুচ্ছ বলে বিবেচিত হয়। ধনীর দুলালি স্বামীর প্রেমে ভাঙা ঘরেও খুঁজে নেয় স্বপ্নের ঠিকানা। রাজপুত্র স্ত্রীর প্রেমে মশগুল হয়ে ছেড়ে দেয় রাজত্বের উত্তরাধিকার। দাম্পত্যজীবনকে সার্থক করতে এমন নিখাদ ও অকৃত্রিম ভালোবাসার বিকল্প নেই ।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসার সম্পর্ক হবে চোখ আর হাতের মতো। হাত ব্যথা পেলে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে, আর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরলে হাত সেটা মুছে দেয়। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে মন থেকে ভালোবাসতে হবে এবং তা প্রকাশও করতে হবে দ্বিধাহীনচিত্তে। অনেক স্বামী আছেন—যারা স্ত্রীদের ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু কখনোই তা মুখে প্রকাশ করেন না। এতে কোনো কোনো স্ত্রী ভাবে—স্বামী বুঝি ভালোই বাসে না তাকে। ফলে মনে মনে সে কষ্ট পায়। নারীদের মনস্তত্ত্ব এমন যে, তারা স্বামীর কাছ থেকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখতে চান। খুনসুটি করতে পছন্দ করেন। রোমান্স কামনা করেন। কিন্তু স্বামী যখন এসব করেন না, স্ত্রী ভেবে নেন—জীবনসঙ্গী তাকে ভালোই বাসছেন না। এই জন্য স্বামীর উচিত, স্ত্রীদের সাথে বসে মন খুলে কথা বলা। স্বামীর পক্ষ থেকে ছোট্ট একটু প্রশংসা কিংবা কোন আকস্মিক উপহারই স্ত্রীর জন্য হয়ে উঠতে পারে অঢেল সুখের উৎস।
অন্যদিকে পুরুষরা স্ত্রীর থেকে আশা করেন—একাগ্রতা, আগ্রহ, সম্মান, আনুগত্য ও আবেদনময়ী উপস্থাপন। স্ত্রীর থেকে এসব না পেলে স্বামী ভাবেন, স্ত্রী তাকে ভালোবাসেন না কিংবা উপেক্ষা করছেন। এই জন্য স্ত্রীর কর্তব্য, স্বামীকে মন থেকে ভালোবাসার পাশাপাশি তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে উপরিউক্ত কাজগুলো সম্পাদন করা। রাসূল * একজন আদর্শ স্ত্রীর কাজ সম্পর্কে বলেন—
‘শ্রেষ্ঠ রমণী সেই, যার প্রতি তার স্বামী দৃষ্টিপাত করলে সে তাকে খুশি করে দেয়, কোনো আদেশ করলে তা পালন করে এবং তার জীবন ও সম্পদে স্বামীর অপছন্দনীয় বিরুদ্ধাচরণ করে না।’ (নাসায়ি : ৩২৩১)
পরস্পরকে গুরুত্ব প্রদান : প্রতিটি মানুষেরই ব্যক্তিত্ববোধ রয়েছে। মানুষমাত্রই চায়—আপনজন তার ব্যক্তিত্ববোধ রক্ষা করে চলুক, তাকে গুরুত্ব দিক। দাম্পত্য সঙ্গী সবচেয়ে কাছের মানুষ। তাই সঙ্গীর ব্যক্তিত্ব রক্ষার গুরুদায়িত্ব তার ওপরই বর্তায়। সবচেয়ে কাছের মানুষের নিকটই যখন কেউ গুরুত্ব পায় না, তখন নিজেকে সে খুবই অসহায় বোধ করে। আস্তে আস্তে তার ভেতর হীনম্মন্যতা তৈরি হয় এবং ক্রমান্বয়ে সে ঝুঁকে পড়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের দিকে। এই জন্য দম্পতির উচিত পরস্পরের ব্যক্তিত্ব, কথা, চিন্তা ও অবদানকে গুরুত্ব দেওয়া। সঙ্গীর কোনো বিষয়কে তাচ্ছিল্য বা বালখিল্য না ভাবা। অন্যের কাছে সঙ্গীকে মর্যাদার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ।
রাসূল তাঁর স্ত্রীগণের ব্যক্তিত্বকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। মানুষের সামনে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিতেন যথাযথ মর্যাদার সাথে। রাসূল-এর একজন ইরানি প্রতিবেশী ছিল, যে খুব ভালো রান্না করতে পারত। একদিন সে রাসূলুল্লাহ -এর জন্য ইরানি খাবার তৈরি করে তাঁকে দাওয়াত করতে লোক পাঠাল। নবিজি তখন আয়িশা (রা.)-এর ঘরে ছিলেন। তাই আয়িশা (রা.)-এর দিকে ইশারা করে বললেন—‘এই দাওয়াতে কি আয়িশাও আছে?’ লোকটি বলল— ‘না।’ রাসূলুল্লাহ বললেন—’ (তাহলে আমিও) না।’ লোকটি চলে গেল। এরপর সে পুনরায় নবিজিকে দাওয়াত করতে এলো। রাসূলুল্লাহ বললেন—’সেও কি?’ লোকটি এবার বলল – ‘হ্যাঁ।’ এবার নবিজি দাওয়াত কবুল করলেন এবং দুজনে মিলে ইরানি খাবার উপভোগ করলেন । ২
এই ঘটনায় বোঝা যায়—স্ত্রীকে রাসূল কত বেশি গুরুত্ব দিতেন। আয়িশা (রা.)-এর হয়তো নতুন বা বিদেশি খাবারের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল, যেমনটি মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই থাকে। রাসূল যদি একাই বিদেশি খাবারের দাওয়াত গ্রহণ করতেন, তাহলে হয়তো আয়িশা (রা.)-এর মনে একটা সুপ্ত আফসোস থেকে যেত। এজন্য তিনি স্ত্রীকে সাথে নিয়েই দাওয়াত গ্রহণে অনড় রইলেন। অনেকটা এমন—‘খেলে স্ত্রীকে নিয়েই খাব; না খেলে কেউ-ই খাব না।’ এর মাধ্যমে মেজবানও বুঝে নিলেন, রাসূল * -এর নিকট তাঁর স্ত্রীর গুরুত্ব কত বেশি! ফলে তারাও পরবর্তী সময়ে ঠিক করে নেবে, উম্মুল মুমিনিনকে কত বেশি মর্যাদা দেওয়া উচিত ।
২ মুসলিম : ৫৪৩৩
সঙ্গীর মানসিক অবস্থা বোঝা : উপভোগ্য দাম্পত্য সম্পর্ক লাভের জন্য সঙ্গীর মানসিক অবস্থা বোঝা অপরিহার্য। মানব মন সব সময় এক থাকে না। সব সময় সবকিছু ভালোও লাগে না। একই কাজ কখনো ভালো লাগে, আবার কখনো বিরক্তিকর ঠেকে। এর কারণ হলো—মানসিক অবস্থার তারতম্য। এই জন্য স্বামী-স্ত্রীর উচিত, তার সঙ্গীর মানসিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখা। সঙ্গী যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, রাগান্বিত কিংবা বিষাদগ্রস্ত থাকে, তখন তার কাছে রোমান্টিক কথা বলা কিংবা মধুর আচরণ প্রত্যাশা করা বোকামি। এতে সঙ্গীর বিরক্তি ও রাগ আরও বেড়ে যায় ।
একইভাবে আনন্দঘন মুহূর্তে হতাশামূলক কথা বলাও একধরনের অপরিণামদর্শিতা। এতে সঙ্গীর মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং সে স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। যদি সঙ্গীর মানসিকতাই হয় নেতিবাচক, তাহলে সবার আগে তার মানসিক অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করা কর্তব্য। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে ।
নারী-পুরুষ দুজন দুই প্রকৃতির। নারীরা চায় সবকিছু শেয়ার করতে, বেশি বেশি কথা বলতে এবং আবেগ ও উচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাতে। অন্যদিকে পুরুষরা চায় চুপচাপ থাকতে, গোপনীয়তা রক্ষা করতে এবং সমস্যা চেপে রাখতে। অতি আবেগ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করাকে তারা অনেক সময় ব্যক্তিত্বের সংকট বলে মনে করে। নারীদের মন খারাপ হলে তারা চায়, কেউ তার সাথে নরম স্বরে কথা বলুক, মান ভাঙিয়ে হালকা করুক তাকে। অন্যদিকে পুরুষদের মন খারাপ হলে তারা পছন্দ করে চুপ থেকে সমাধান খুঁজতে। এ সময় অধিক কথাবার্তা তাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। কঠিন সময়ে একাকী থাকতেই তারা পছন্দ করে। এগুলো নারী- পুরুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য ।
স্বামী-স্ত্রী উভয়ই যদি সঙ্গীর এই মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আচরণ করে, প্রত্যাশা উপস্থাপন করে, তাহলে ভুল বোঝাবুঝির পরিমাণ কমে আসবে, ইনশাআল্লাহ ।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক : দাম্পত্য সম্পর্ক এমন হওয়া উচিত, যেখানে উভয়ে উভয়ের নিকট যেকোনো কথা বা বিষয় শেয়ার করতে পারে নির্ভয়ে ও নিঃসংকোচে । এমন সম্পর্ক কখনোই কাম্য নয়, যেখানে একজন আরেকজনের নিকট প্রয়োজনীয় কথা বলতেও ভয় পায়। এ রকম দমবন্ধ পরিবেশে ভালোবাসা কখনো সৌরভ ছড়ায় না। সেখানে বিরাজ করে কেবলই মনিব- দাসীর দাপ্তরিক আচরণ ।
রাসূল স্ত্রীদের সঙ্গে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি এতটাই মিশুক ছিলেন যে, স্ত্রীরা তাঁর সাথে রাগের স্বরেও কথা বলতেন অনেক সময়। একদিন আবু বকর (রা.) উম্মুল মুমিনিন আয়িশা (রা.)-এর ঘরে গিয়ে দেখলেন—আয়িশা (রা.) নবিজির সাথে রাগতস্বরে নিজের ক্ষোভ ঝাড়ছেন! আর নবিজি চুপ করে শুনছেন। মেয়ের এমন আচরণে আবু বকর (রা.) অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। মেয়েকে শাসিয়ে বললেন—’এত বড়ো স্পর্ধা তোমার, নবিজির সাথে রাগের স্বরে কথা বলছ!’ এ কথা বলেই মেয়ের ওপর হাত তুলতে উদ্যত হলেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে রাসূল দাঁড়িয়ে গেলেন বাবা-মেয়ের মাঝখানে। রাসূল -কে রক্ষাকবচ হতে দেখে আবু বকর (রা.) নিজেকে সংবরণ করলেন এবং মেয়ের ওপর ক্ষোভ নিয়েই প্রস্থান করলেন। আবু বকর (রা.) চলে যাওয়ার পর নবিজি আয়িশা (রা.)-কে বললেন—’দেখেছ, কীভাবে লোকটার হাত থেকে তোমাকে বাঁচালাম!’ নবিজির কথা শুনে আয়িশা (রা.) হেসে দিলেন। কারণ, নবিজি আবু বকর (রা.)-এর সম্বোধনে ‘তোমার বাবা’ না বলে ‘লোকটা’ বলেছেন । যেহেতু আবু বকর (রা.) আয়িশা (রা.)-কে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন, তাই আয়িশা (রা.)-কে খুশি করার জন্য নবিজি এই অপরিচিতবোধক শব্দ ব্যবহার করেন। অথচ এই আয়িশা (রা.)-ই কিছুক্ষণ আগে নবিজির ওপর রাগ ঝাড়ছিলেন ।
কিছুক্ষণ পর আবু বকর (রা.) পুনরায় মেয়ের ঘরে এসে দেখলেন, আয়িশা (রা.) ও নবিজি হাসি-ঠাট্টা করছেন। তাঁদের এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখে আবু বকর (রা.) মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বললেন—’ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনাদের এই প্রশান্তির বলয়ে আমাকেও শামিল করুন; যেমনটা করেছিলেন কিছুক্ষণ আগের বিবাদে।’ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছাড়া এমন প্রফুল্ল পরিবেশ কখনোই সম্ভব নয় ।
অর্থবহ সময় দান : স্ত্রীদের সাথে সময় কাটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছাড়া পারস্পরিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না। বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে আমরা যেন যান্ত্রিক জীবনে প্রবেশ করেছি। সারাদিন কাজ নিয়েই পড়ে থাকি। রাতের বেলা বাসায় ফিরে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিই। স্ত্রীদের সাথে কথা বলার কিংবা তাদের অনুভূতির দিকে মনোযোগ দেওয়ার ফুরসতই যেন আমাদের নেই। অথচ তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে আমরা চাইলেই কিন্তু পারি—অফিসে বসেও স্ত্রীর খোঁজ নিতে। কাজের ফাঁকে তাকে ছোট্ট করে একটা ম্যাসেজ দিয়ে রাখতে। শত ব্যস্ততার মাঝেও তাকে ভালোবাসার কথা জানাতে ।
রাসূল প্রতিদিন সকালে স্ত্রীদের সাথে দেখা করতেন। তাঁদের খোঁজখবর নিতেন। সারাদিন রাষ্ট্রীয় ও নবুয়তি দায়িত্ব পালন শেষে আসরের পর আবার প্রত্যেক স্ত্রীর ঘরে যেতেন এবং তাঁদের সাথে আনন্দঘন সময় কাটাতেন। রাসূল -এর স্ত্রী ছিলেন সর্বমোট ১১ জন। তাঁদের মধ্যে দুজন রাসূল -এর জীবদ্দশাতেই মারা গিয়েছিলেন। বাকি নয়জন স্ত্রীর সাথে তিনি দিন ভাগ করে থাকতেন। এ ব্যাপারে কখনো অবিচার করতেন না। একজন স্ত্রী প্রতি নয় দিন পর নবিজির সাথে থাকার সুযোগ পেতেন। যদি নয় দিন পরপর তিনি স্ত্রীদের সাথে দেখা করতেন, তবে সেটা তাঁদের জন্য অনেক কষ্টকর হতো। তাই রাসূল স্ত্রীদের সাথে প্রতিদিনই দুইবার করে সাক্ষাৎ করতেন এবং উপভোগ্য সময় কাটাতেন। স্ত্রীরা তাই ভাবতেন— রাসূল তো সব সময় তাঁদের সাথেই আছেন ।
সঙ্গিনীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা : আগেই বলেছি, নারীরা সাধারণত বলতে পছন্দ করে। তারা খুব করে চায়, কেউ তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুক। এই জন্য স্বামীর উচিত, স্ত্রী কিছু বললে তা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং তার প্রশংসা করা; এমনকী তার কথা কম গুরুত্বপূর্ণ কিংবা গুরুত্বহীন হলেও। এতে স্ত্রীর মন হালকা হয় এবং পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় । স্ত্রী যদি বাচাল প্রকৃতির হয়, তবে অন্য সময়ে উত্তম উপায়ে তাকে সংশোধনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
বিনোদন ও রোমান্টিসিজম : জমিনে পানির যেমন প্রয়োজন, দাম্পত্য সম্পর্কে বিনোদন ও রোমান্টিকতা তেমনই প্রয়োজন। বিনোদন ছাড়া দাম্পত্য সম্পর্ক শুষ্ক মরুভূমির রূপ ধারণ করে। সেখানে ফলে না কোনো সবুজ তরু কিংবা উপকারী ফসল। বিনোদনের সাথে স্ত্রীর মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এজন্য স্ত্রীর ভরণ-পোষণ যেমন স্বামীর দায়িত্ব, তেমনই তার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখাও স্বামীর একান্ত কর্তব্য ।
শরিয়াহর নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে থেকেই যতদূর সম্ভব বিনোদন গ্ৰহণ করা উচিত। যেমন : স্ত্রী কোনো বৈধ কাজ করতে পছন্দ করলে তাকে সে কাজ করতে সুযোগ করে দেওয়া। প্রতিদিন কিছু সময় তার সাথে হাসি-ঠাট্টা ও নির্জনে বৈধ খেলাধুলা করা। তাকে নিয়ে বাড়ির ছাদে বা ঘরের আঙিনায় পায়চারি করা। সমুদ্রসৈকত, চিড়িয়াখানা, জাদুঘর বা কোনো দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যাওয়া। সামর্থ্য থাকলে উমরা বা বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গী করা।
নবি * স্ত্রীদের সাথে নিয়মিত গল্প-কৌতুক ও খেলাধুলা করতেন। স্ত্রীর কাছে যাওয়ার পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। রাসূল অনেক সময় আয়িশা (রা.)-এর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেন। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গল্প করতেন এবং খুনসুটি করতেন। আয়িশা (রা.) যে মশক পানি পান করতেন, রাসূল ঠিক সেই মশকের একই স্থানে ঠোঁট লাগিয়ে পানি পান করতেন। আয়িশা (রা.) বর্ণনা করেন—
‘এক সফরে আমি রাসূলুল্লাহ -এর সঙ্গে ছিলেন। তখন আমি কিশোরী। রাসূল সঙ্গীদের বললেন—“তোমরা এগিয়ে যাও।” অতঃপর তিনি আমাকে বললেন—“এসো দৌড় প্রতিযোগিতা করি।” আমি তাঁর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম এবং দৌড়ে তাঁর চেয়ে এগিয়ে গেলাম। পরবর্তী সময়ে আমি যখন কিছুটা মোটা হয়ে গেলাম, তখন কোনো এক রাতে রাসূল -এর সাথে আবারও দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম। কিন্তু এবার তিনি বিজয়ী হয়ে আমাকে বললেন—“আয়িশা, ওই দিনের সমান করে নিলাম।”” (আবু দাউদ : ২৫৭৮)
অপর একটি বর্ণনায় আয়িশা (রা.) বলেন—
‘ঈদের দিনে হাবশি লোকেরা ঢাল ও বর্শা নিয়ে খেলা করত । আমি রাসূলুল্লাহ -কে বলেছিলাম কিংবা তিনিই আমাকে বলেছিলেন—“তুমি কি দেখতে আগ্রহী?” আমি বললাম—“হ্যাঁ।” তারপর তিনি আমাকে তাঁর পেছনে দাঁড় করালেন। আমার গাল তাঁর গালের ওপর ছিল। তিনি বলছিলেন—“হে বনু আরফিদা! চালিয়ে যাও।” যখন আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, তিনি আমাকে বললেন—“যথেষ্ট হয়েছে?” বললাম—“হ্যাঁ।” তিনি বললেন- “এখন যাও।” অর্থাৎ, একসময় আমি নিজেই ধৈর্য হারিয়ে ফেললাম এবং সেখান থেকে চলে যেতে চাইলাম, কিন্তু রাসূল * ধৈর্যহারা হলেন না।’ (বুখারি : ২৯০৬)
পারস্পরিক সহযোগিতা : স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কাজে সহায়তার চর্চা সম্পর্কের মাঝে আস্থা ও সহমর্মিতা তৈরি করে। বৈবাহিক জীবনের প্রথম দিকে স্বামীর তুলনায় স্ত্রীর ত্যাগটাই বেশি থাকে। কারণ, বিয়ের পর একটি মেয়ে সবকিছু ছেড়ে নতুন একটি পরিবারে যোগ দেয়। সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয় নিজেকে। বিপরীতে স্বামীকে প্রায় কিছুই ছাড়তে হয় না। না পরিবার, না আত্মীয়স্বজন। তাই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সহযোগিতা করা স্বামীর কর্তব্য।
এ ছাড়াও তারা সন্তান লালন-পালনের প্রধান দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সারাদিন সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকে। পুরো সংসার তদারকি করে । খেয়াল রাখে কার কী প্রয়োজন। কোনো সাপ্তাহিক ছুটিও তাদের থাকে না। একটানা কাজ করে যেতে হয় জীবনভর। স্বামীর উচিত—যত দূর পারা যায়, স্ত্রীকে সাংসারিক কাজে সাহায্য করা। সামর্থ্য থাকলে কাজের লোকের ব্যবস্থা করা। বাড়ি ফিরে অহেতুক টিভির স্ক্রিন কিংবা মোবাইলে ব্যস্ত না থেকে স্ত্রীর সাথে গল্প করতে করতেও কাজে সহযোগিতা করা যায় কিংবা বাচ্চাদের দেখে রাখা, তাদের পড়ানো যায়। এগুলো রাসূল -এর সুন্নত।
আল্লাহর রাসূল যতটুকু সময় ঘরে থাকতেন, স্ত্রীদেরকে ঘরের কাজে ও রান্নাবান্নায় সহযোগিতা করতেন। আসওয়াদ (রা.) বর্ণনা করেন—
‘একবার আয়িশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো—“রাসূল ঘরে থাকাকালে কী করতেন?” জবাবে আয়িশা (রা.) বললেন— “তিনি স্ত্রীদের সাংসারিক কাজে সহযোগিতা করতেন। আর যখন নামাজের সময় হতো, নামাজে যেতেন।”” (বুখারি : ৬৭৬)
আয়িশা (রা.) আরও বলেন—
‘রাসূল জুতা ঠিক করতেন, কাপড় সেলাই করতেন এবং তোমরা যেমন ঘরে কাজ করো, তেমনই কাজ করতেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৫৩৮০)
কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়ানো : জীবনে উত্থান-পতন খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। শারীরিক-অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন দিক থেকে সংসারে কঠিন সময় আসতে পারে। হতে পারে স্ত্রী অসুস্থ কিংবা স্বামীর চাকরি-ব্যবসায় বা কৃষিক্ষেত্রে চরম ধস। সঙ্গীর এই কঠিন সময়ে পাশে থাকা স্বামী-স্ত্রীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কথায় আছে, বিপদেই বন্ধু চেনা যায়। দাম্পত্য সঙ্গীর কঠিন সময়ে যদি অপরজন চলে যায় বা পাশে না থাকে, তবে এর চেয়ে অকৃতজ্ঞতা আর হতে পারে না ।
রাসূল -এর কঠিন দুর্দিনে তাঁর পবিত্রা স্ত্রী খাদিজা (রা.) সার্বিক দিক থেকে পাশে ছিলেন । অর্থ দিয়ে, সময় দিয়ে; এমনকী শ্রম দিয়েও তাঁর পাশে ছায়ার মতো ছিলেন। রাসূল নিজেই তাঁর সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন-
‘আল্লাহ তায়ালা আমাকে তাঁর চেয়ে উত্তম কাউকে বিকল্প হিসেবে দেননি। যখন সবাই আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছে, তখন সে বলেছে সত্যবাদী। যখন সবাই আমাকে বঞ্চিত করেছে, তখন সে আমাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে। আর তাঁর মাধ্যমেই আল্লাহ আমাকে সন্তান দান করেছেন।’ (মুসলিম : ২৪৩৭ )
রাসূল -এর মেয়ে জয়নাব (রা.) ইসলাম গ্রহণ করলেও স্বামীর ভালোবাসায় মক্কাতেই ছিলেন। তাঁর স্বামী ‘আবুল আস ইবনে রাবি’ তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তবে তিনি ইসলামের বিরোধিতাও করতেন না। বদর যুদ্ধের সময় আবুল আস মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দি হন । এই খবর শুনে জয়নাব (রা.) স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে নিজের গলার হার মদিনায় পাঠিয়ে দেন। হারটি জয়নাব (রা.)-এর বিয়ের সময় তাঁর মা খাদিজা (রা.) নিজ গলা থেকে খুলে উপহার দিয়েছিলেন। রাসূল এই হার দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। অশ্রুতে ভরে উঠল তাঁর চোখ। তিনি সাহাবিদের বললেন—’তোমরা যদি রাজি থাকো, তাহলে এ হার ফিরিয়ে দাও এবং বন্দিকে মুক্তিপণ ব্যতীতই মুক্ত করে দাও।’
এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়, নবিজির মেয়ে তাঁর স্বামীকে কতটা ভালোবাসতেন। পরলোকগত মায়ের শেষ স্মৃতি, নিজের গলার হার সঁপে দিয়েছেন স্বামীর মুক্তির জন্য। স্বামীর দুর্দিনে ও কঠিন সময়ে পাশে থাকার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ।
প্রশংসা করা : নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে? সেই প্রশংসা যদি আসে একান্ত প্রিয়জনের মুখ থেকে, তাহলে আর খুশির অন্ত থাকে না । স্বামী-স্ত্রীর উচিত পরস্পরের ভালো গুণ, কাজ, পছন্দ, সৌন্দর্য, রান্না ইত্যাদি নিয়ে প্রশংসা করা। এতে দম্পতিযুগল নিজের ও সঙ্গীর ব্যাপারে আস্থাশীল হয়। নয়তো সে ভাবে, বিপরীতজন তাকে নিয়ে খুশি নয়। তাই তার মাঝে হীনম্মন্যতা কাজ করে। এজন্য স্ত্রীর প্রশংসায় কৌশলে মিথ্যা বলাকেও জায়েজ করেছে ইসলাম। রাসূল ‘তিন ক্ষেত্র ছাড়া মিথ্যা বলা বৈধ নয়—স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য মিথ্যা বলা, যুদ্ধক্ষেত্রে মিথ্যা বলা এবং মানুষের মধ্যে আপস- মীমাংসার জন্য মিথ্যা বলা।’ (আবু দাউদ : ৪৯২১)
রাসূল তাঁর স্ত্রীদের প্রশংসা করতেন। আয়িশা (রা.) বর্ণনা করেন— -এর স্ত্রীগণের মধ্য থেকে খাদিজা (রা.)-এর চেয়ে অন্য কোনো স্ত্রীর প্রতি অধিক হিংসা করিনি। কারণ,
‘আমি রাসূল
রাসূল প্রায়ই তাঁর কথা স্মরণ করতেন এবং তাঁর প্রশংসা
করতেন।’ (বুখারি : ৩৮১৮)
স্ত্রীর কোনো গুণ বা রূপের প্রশংসা করে তাকে আদুরে নামে ডাকা যেতে পারে। এটা বিশ্বনবির সুন্নাহ। তিনি স্ত্রীদের বিভিন্ন আদুরে নামে ডাকতেন ৷ আয়িশা (রা.)-কে আদর করে ডাকতেন ‘হুমায়রা’। হুমায়রা অর্থ—সুন্দর চিবুকের অধিকারিণী বা লালচে চেহারার অধিকারিণী। আম্মাজান আয়িশা (রা.) নবিজির ভালোবাসা ও প্রশংসায় কবিতা লিখেছিলেন—
‘আমার একটি সূর্য আছে, আকাশেরও একটি সূর্য
আমার সূর্য আকাশের সূর্যের চেয়ে উত্তম।
কেননা, পৃথিবীর সূর্য ফজরের পর উদিত হয় আমার সূর্য উদিত হয় এশার পর। ৩
ইসলামি সীমার মধ্যে থাকা : দাম্পত্যজীবনকে উপভোগ্য করার জন্য শরিয়াহসম্মত অনেক মাধ্যম ও উপায়-উপকরণ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট কিছু সীমারেখা ছাড়া সমগ্র পৃথিবী আমাদের জন্য উপভোগ্য। তবে খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যেন বাড়াবাড়ি করে না ফেলি। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। ক্ষণিকের আনন্দ পাওয়ার জন্য এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা পরকালীন মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রিয় মানুষটিকে খুশি করার জন্য আমরা গল্পগুজব, খুনসুটি করব; কিন্তু কখনো মাত্রা ছাড়িয়ে যাব না। হালালের সীমার মধ্যে থেকেই দাম্পত্যজীবনকে উপভোগ করব। মহান আল্লাহ বলেন—
‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করবে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করে যাবে, আল্লাহ তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে থাকবে অনন্তকাল। আর তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণা ও অপমানজনক শাস্তি।’ (সুরা নিসা : ১৪)
৩. আর- রাহিকুল মাখতুম অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান : আল্লাহ মানুষের দাম্পত্যজীবনকে এমনভাবে সাজিয়েছেন, স্বামীই সেখানে যাবতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব বহন করবে। আর ঘরের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্বামীর যাবতীয় সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ করবে স্ত্রী। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
الرِّجَالُ قَومُوْنَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا اَنْفَقُوا مِنْ اَمْوَالِهِمْ ، فَالصّلِحُتُ قُنِثت حفظتُ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ الله –
‘পুরুষ নারীর তত্ত্বাবধায়ক। আল্লাহ তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। কারণ, পুরুষ নিজের ধনসম্পদ ব্যয় করে। কাজেই সতীসাধ্বী স্ত্রীরা আনুগত্যপরায়ণ হয় এবং পুরুষদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহর হেফাজত ও তত্ত্বাবধানে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করে থাকে।’ (সূরা নিসা : ৩৪)
এই জন্য স্বামীর কর্তব্য হলো—স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এটা স্ত্রীর অধিকার। স্ত্রীকে যথাযথভাবে ভরণ-পোষণ না দিলে সংসারে কখনোই শান্তি বজায় থাকতে পারে না। স্বামী নিজের সাধ্যানুযায়ী ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবেন; এটা তার মৌলিক দায়িত্ব। শত চেষ্টা সত্ত্বেও যদি সংসারে টানাপোড়েন বজায় থাকে, সেটি ভিন্ন কথা । কিন্তু আয়-রোজগারের চেষ্টা না করে ঘরে বসে থাকা কিংবা ভবঘুরের মতো জীবনযাপন করা নিশ্চিতভাবেই অধিকার হরণের অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি স্ত্রীর সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাও স্বামীকেই করতে হবে। তার জন্য নিরাপদ ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়িতে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেন তার পর্দা-আব্রু-সম্মান ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় ।
চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রচেষ্টা : ওই দম্পতি সর্বাপেক্ষা উত্তম, যে নিজের চরিত্র হেফাজতের পাশাপাশি সঙ্গীর চারিত্রিক ও আত্মিক উন্নয়নেও বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। ভালোবাসার সৌরভ মেখে তাকে উৎসাহ দেয়। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল বলেন-
‘সেই ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তায়ালা রহম করুন, যে গভীর রজনিতে উঠে সালাত আদায় করে এবং প্রিয়তমা স্ত্রীকেও জাগিয়ে দেয়। স্ত্রী জেগে উঠতে গড়িমসি করলে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়, যাতে সে সজাগ হয়। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা সেই মহিলার প্রতিও রহম করুন, যে গভীর নিশিতে জেগে সালাত আদায় করে এবং প্রিয়তম স্বামীকেও জাগিয়ে দেয়। স্বামী জেগে উঠতে গড়িমসি করলে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়, যাতে সে জেগে ওঠে।’ (আবু দাউদ : ১৩০৮)